Advertisement
১৭ মে ২০২৪
‘স্ত্রৈণ’, কিন্তু ‘পতিব্রতা’: সমাজ-নির্দিষ্ট ভূমিকায় ক্ষমতার ছাপ
Woman Empowerment

নারী অধিকারের ঘরে-বাইরে

আমরা নারীনির্যাতন রুখতে পর্ষদ বানাই, সভা করি, মিটিং-মিছিলে স্লোগান তুলি— অথচ, পাশের বাড়ির নির্যাতিতা নববধূটির হয়ে আওয়াজ তুলি না।

প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২১ ০৪:৪৩
Share: Save:

লিঙ্গসমতা বিষয়ক একটি সারস্বত আলোচনাসভায় সম্প্রতি প্রশ্ন উঠল, “স্ত্রৈণ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ কি হবে?” বহু চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করে দেখা গেল, আশ্চর্য, ‘স্ত্রৈণ’ শব্দটার কোনও যথাযথ স্ত্রীলিঙ্গ শব্দই নেই। নিকটতম শব্দ হিসাবে পাওয়া গেল ‘পতিব্রতা’ শব্দটি। কিন্তু যে নঞর্থক ও শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে ‘স্ত্রৈণ’ শব্দটির ব্যবহার, ‘পতিব্রতা’ শব্দের ব্যবহার বরং তার উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে— শব্দটি নিতান্তই ‘সদর্থক’, মূলত লক্ষ্মীমন্ত, স্বামীঅন্তপ্রাণ, কর্তব্যপরায়ণ রমণী বোঝাতেই এর ব্যবহার।

এ এক বিচিত্র ব্যবস্থা। ভাবলে অবাক লাগে, বিবাহ পদ্ধতিটি কী নিদারুণ বিপরীত শর্তে দু’টি মানুষকে একটি সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করে! অবশ্য ‘স্বামী’ এবং ‘স্ত্রী’ শব্দ দু’টির উৎস ও অর্থ অনুসন্ধান করলেই বিবাহোত্তর যৌথ জীবনে তাদের এই ভিন্নধর্মী ভূমিকা ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। স্বামী শব্দটাকে ভাঙলে পাওয়া যাবে ‘স্ব’ যুক্ত ‘আমিন্’। তাই সংস্কৃত ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ, যিনি নিজেই নিজের অধিকর্তা বা মালিক। ভূস্বামী শব্দের অর্থ যেমন ভূমির অধিকর্তা। আবার স্বামী শব্দের যে ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘হাসব্যান্ড’, তার উৎপত্তি ‘হুসবন্ডি’ শব্দটি থেকে। ‘হুস’ অর্থাৎ গৃহ এবং ‘বন্ডি’ অর্থাৎ অধিকর্তা। অর্থাৎ, ভাষানির্বিশেষে ‘স্বামী’ শব্দটির সঙ্গে অধিকার বা স্বত্বধারণের বিষয়টির সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, যা স্থান ও কালের সীমানা পেরিয়ে সুব্যাপ্ত। অন্য দিকে, সংস্কৃত ‘স্ত্রী’ শব্দের অর্থ নারী। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ওয়াইফ’ এর অর্থও নারী বা বিবাহিত রমণী। প্রাচীন ইংরেজি অনুযায়ী ‘ওয়াইফ’ শব্দের উৎপত্তি ‘উইফ’ শব্দ থেকে, যা এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ ‘ঘুইব’ থেকে; যার অর্থ আবার ‘লজ্জা’!

স্বামী ও স্ত্রী— শব্দদ্বয়ের সূত্র ও অর্থই বৈবাহিক সম্পর্কটিতে এই দুই ব্যক্তির পারস্পরিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়। স্বামী হলেন কর্তা— তিনি অধিকার করেন। স্ত্রী হলেন শুধুই নারী। তাঁর লিঙ্গই তাঁর পরিচয়। উৎসভেদে সে পরিচয় আবার লজ্জারও। সভ্যতার আদিকাল থেকে আজও বৈবাহিক সম্পর্কে স্বামী ও স্ত্রীর এই ভিন্নমেরুর অবস্থান।

স্বামী ও স্ত্রী শব্দদ্বয়ের এই ঐতিহাসিক উৎসই স্ত্রৈণ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গের অনুপস্থিতির হিসাব মিলিয়ে দেয়। যিনি কর্তা, বিষয়ের অধিকার যাঁর, তিনি স্ব-খেয়ালে চলবেন। অন্যের কথা শোনার, জানার কিংবা মানার দায় তাঁর নয়। বিবাহের মতো আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নয়। দায় থাকলে তিনি প্রেমিক পুরুষ নন, দায়িত্ববান স্বামী নন; বরং সমাজের চোখে কাপুরুষ, স্ত্রৈণ। কিন্তু সংসারের বধূটির সেই দায় থাকে, বরং বলা যায় সেটিই তাঁর উপজীব্য। এই দায়ভারই সমাজ-সংসারে তাঁকে ‘আদর্শ নারী’ করে তোলে।

সংসারে স্বামী-স্ত্রীর এই চরিত্র চিত্রায়ন যুগে যুগে পুরুষকে নারী-অবদমনের পাঠ পড়িয়েছে; শিখিয়েছে যে, সংসারে তাঁর প্রয়োজনটাই মুখ্য— তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর যদি বা কোনও প্রয়োজন থাকে, তা হল গৌণ। স্বামীর কথা শোনার, তাঁর খেয়াল রাখার, যত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তাঁর মতো করে চলার, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিসর্জন দিয়ে তাঁর সংসারকেই নিজের সংসার, তাঁর বাড়িকেই নিজের বাড়ি এবং তাঁর ইচ্ছা অনুসারে নিজের গোটা জীবনটাকে সাজিয়ে নেওয়ার সবটুকু দায়বদ্ধতা স্ত্রীর। কোনও পুরুষ এই ছকে-বাঁধা নিয়মের অন্যথা করে জীবনসঙ্গিনীর ইচ্ছের দাম দিতে গেলেই সমাজ-সংসারে তাঁর পরিচয় হবে ‘স্ত্রৈণ’।

অবদমন, নির্যাতন বা হিংসাত্মক কার্যকলাপ কিন্তু পুরুষের স্বভাবসিদ্ধ নয়। অস্ট্রেলীয় সমাজবিজ্ঞানী আর ডব্লিউ কনেল তাঁর লিঙ্গক্রম তত্ত্বে বলছেন যে, অপেক্ষাকৃত বিত্তবান বা বলবান পুরুষ শুধুমাত্র সমাজে নারীকেই অবদমিত করে না, অবদমন করে তার থেকে কম ধনবান, কম শক্তিশালী বা পিছিয়ে থাকা পুরুষ গোষ্ঠীকেও। কারণ তার ধন, বল বা সম্পদ তাকে এই অবদমনের শিক্ষা ও সুযোগ দুটোই দেয়। অর্থাৎ, অবদমন মূলত ক্ষমতার প্রশ্ন, শুধু লিঙ্গের প্রশ্ন নয়। অফিসের উচ্চপদস্থ মহিলা আধিকারিক যখন তাঁর অধস্তন পুরুষ কর্মচারীটিকে অবদমন করছেন, তখন সেই পুরুষ কর্মচারীটি তার প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু, বাড়ি ফিরে গিয়ে সেই ব্যক্তিই হয়তো তাঁর স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছেন। নারীবাদী লেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী কমলা ভাসিন যেমন উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, বধূ হিসাবে নির্যাতিত কোনও মহিলাই যখন পরবর্তী কালে শাশুড়ি হন, তখন কিন্তু তিনিও তাঁর পুত্রবধূর উপর সমান বা অধিক নির্যাতন করেন। অর্থাৎ, অবদমন পুরুষের, বা সহনশীলতা নারীর সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। বিষয়টি সম্পূর্ণত সমাজ দ্বারা আরোপিত এবং একটি অর্জিত জ্ঞানমাত্র, যার সঙ্গে সমাজে বর্তমান ক্ষমতার গতিতত্ত্বের বিশেষ যোগ আছে। সে ক্ষমতা তাই শুধু লিঙ্গভিত্তিক নয়। অর্থের, শক্তির, উত্তরাধিকারসূত্রের, জাতির, ধর্মের বা অন্য আরও নানা বিষয়েরই হতে পারে।

উভয়সঙ্কটের কথা এই যে, আরোপিত ও শিখিয়ে দেওয়া এই সমাজপদ্ধতি এক দিকে পুরুষকে নারী-অবদমনের পাঠ পড়ায়, অ-সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়; আবার অন্য দিকে আইনানুগ পদ্ধতিতে, নারী নির্যাতনে তাকেই শাস্তি দেয়, অপরাধী দেগে দিয়ে জেলে ঢোকায়। কাফকার উপন্যাসের মতোই, এই পরিস্থিতি বৈপরীত্যে ভরা, অযৌক্তিক ও দ্বন্দ্বমূলক।

দ্বন্দ্ব আরও বহু জায়গায়। আমরা নারীনির্যাতন রুখতে পর্ষদ বানাই, সভা করি, মিটিং-মিছিলে স্লোগান তুলি— অথচ, পাশের বাড়ির নির্যাতিতা নববধূটির হয়ে আওয়াজ তুলি না; নিজের-ই দাদা, কাকা, ভাই যখন শিক্ষিতা ও ঘরোয়া পাত্রীর খোঁজে ভাবী বধূটিকে বিয়ের আগে চাকরি ছাড়ার শর্ত দেয়, তখন আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকি। আমরা ‘মেয়েরা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্য নয়’ বলতে বলতে জাতীয় স্তরে নারীক্ষমতা-উন্নয়নের নীতিনির্ধারণ করি, কর্মপন্থা বানাই। আমরা ‘মেয়েদের আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসা উচিত’ বলতে বলতে লোকসভায় এক-তৃতীয়াংশ মহিলা আসন সংরক্ষণের বিরোধিতা করি। আমরা নিজের মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে বিদেশ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ছেলের জন্যে সংসারের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ পুত্রবধূ খুঁজি, যে বহু সাধের গানের রেওয়াজটুকুও ছেড়ে দেবে সংসারের জোয়াল টানতে। আমরা নিজের জন্যে ম্যারেজ অ্যাক্টে, উত্তরাধিকার আইনে সংশোধনের দাবি তুলি, সংসারের কাজে এগিয়ে আসা স্বামীর চরিত্র চিত্রায়নের বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলি— অথচ আমাদেরই ছেলে, ভাই, দাদা সেটি করতে গেলে তাকে স্ত্রৈণ বলি!

আমরা নিজেরাই নিজেদের অবদমনের পথ তৈরি করি। আবার সেই অবদমনের বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তুলি, তার সংশোধনে নীতিনির্ধারণ করি। আমাদের চেতনার পথে দ্বিমুখী টান চলতেই থাকে। সেই পথের চেনা মুখগুলোকে আর চ্যালেঞ্জ করা হয় না।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman Empowerment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE