Advertisement
১৬ মে ২০২৪
School Syllabus

ফিরে যাচ্ছি ঘোর অন্ধকারে

স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে ডারউইন বাদ যাওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রায় একই কার্য-কারণের ফলে। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের আগের যুগে কি ফিরে যাচ্ছি আমরা?

An image of book

স্কুলপাঠ্য থেকে বাদ চলে যাচ্ছে মোগল ইতিহাস, দশম শ্রেণি পর্যন্ত জীববিদ্যায় ডারউইন ও বিবর্তনবাদও। প্রতীকী চিত্র।

আকাশ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৩ ০৫:১২
Share: Save:

তুমি তোমার ছেলেকে/ অহোরাত্রি অসংখ্য মিথ্যার বিষ গিলিয়েছ।/...তোমার জন্য আমার কোনো ভাবনা নেই,/ কিন্তু/ তোমার ছেলের জন্য আমার বড় দুঃখ হয়।” নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পঙ্‌ক্তিগুলো ইদানীং তাড়া করছে খুব, কারণ ঘরে ঘরে কত জনেরই তো আছে শিশুসন্তান, স্কুলে যাচ্ছে তারা। আর এ দিকে দেখতে পাচ্ছি রমরমিয়ে চালু হয়ে যাচ্ছে নতুন শিক্ষানীতি, যেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর স্তরে পাল্টে যাচ্ছে সব পরিচিত ধাঁচা, পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যসূচি। সব তৈরি হচ্ছে নতুন করে। করতেই হবে, কেননা এ নীতির মূল কথাই হল ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ (আইকেএস)-এর অন্তর্ভুক্তি, প্রাচ্যও নয়, বিশুদ্ধ ভারতীয় জ্ঞানৈতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।

আর এ কাজ করতে গিয়ে অ্যালোপ্যাথি পড়ুয়ার আবশ্যক হয়ে যাচ্ছে আংশিক হোমিয়োপ্যাথি, কবিরাজি, ইউনানি শিক্ষা, স্কুলপাঠ্য থেকে বাদ চলে যাচ্ছে মোগল ইতিহাস, দশম শ্রেণি পর্যন্ত জীববিদ্যায় ডারউইন ও বিবর্তনবাদও। মদনমোহন মালবীয়র মার্গদর্শনে ঢেলে সাজানো হচ্ছে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, ছাত্রদের পড়তে হবে বৈদিক গণিত, বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে শুল্বসূত্রের উপর। জৈব রসায়ন, জৈব পদার্থবিদ্যার সঙ্গেই হবে আয়ুর্বেদ চর্চা। গণিতের সঙ্গেই পড়ানো শুরু হবে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ। ‘দীক্ষারম্ভ’-এ পড়ুয়াদের নিয়ে যেতে হবে শিক্ষাপ্রাঙ্গণ সংলগ্ন মন্দির, গুরুকুল বা আয়ুর্বেদ কেন্দ্রের মতো স্থানে। এই সব কাজে শিক্ষকদের পারঙ্গম ও বিশ্বাসী করে তুলতে করানো হবে রিফ্রেশার্স কোর্স, যা তাঁদের মনে তৈরি করবে ‘আইকেএস’-এর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সহায়ক হবে অতি উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণায় ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে, বৃহত্তর লাভ সেই বহুপ্রতীক্ষিত সংমিশ্রণ— বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, অঙ্ক সমাজবিজ্ঞান, সব কিছুর সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন।

ডাক্তার হয়ে বেরোনোর সময় হিপোক্রেটিক ওথ-এর বদলে ‘চরক শপথ’ চালু হয়ে গিয়েছিল করোনাকালেই। আর সংখ্যার জোরে বিরোধী মতকে উপেক্ষা করেই ‘নতুন শিক্ষানীতি ২০২০’-ও পাশ হয়েছিল ঘরবন্দি পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে। মনে পড়তে পারে, ভারতীয় সংবিধানের প্রগতিশীলতা ও কুসংস্কার-বিরোধী মানসিকতাকে দূরে ঠেলে মুরলী মনোহর জোশী জ্যোতিষবিদ্যাকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে স্বীকৃতি দেওয়ার কাজটি সেরে রেখেছিলেন। অবশ্য এমন সংগঠিত কায়দায় জ্যোতিষচর্চার সার্বিকীকরণ করে উঠতে পারেননি।

এ রাজ্যে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার। ভূমি সংস্কারের স্বপ্নসূচনা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার বন্দোবস্ত। যুগসঞ্চিত সুপ্তিতে সাড়া পড়ার সেই সব মুহূর্ত কাকতালীয় হলেও হিমগিরি শুনছিল সূর্যের ইশারা। ভারতের তরুণতম প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভাষণে তখন দেশকে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত করে তোলার সঙ্কল্প। দেশের সংযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে তিনি নিয়ে আসছেন স্যাম পিত্রোদার মতো মানুষকে। পাশাপাশি শ্রীহরিকোটা থেকে ধারাবাহিক ভাবে পাড়ি জমাচ্ছে ‘ইনস্যাট’ সিরিজ়ের উপগ্রহগুলি। ঘরে ঘরে টিভির আগমনকে বিলম্বিত করার কোনও সুযোগ থাকছে না, তিরাশিতে কপিল দেব আর ছিয়াশিতে মারাদোনার দৌলতে। ছোটপর্দায় সাপ্তাহিক সম্প্রচার রামায়ণ সিরিয়ালের, রবিবাসরীয় সকাল যেন জনশূন্য কার্ফু। সেই প্রথম নিজস্ব রাজনীতির তুরুপের তাসটি খুঁজে পেয়েছিল সঙ্ঘ পরিবার, সর্বোত্তম স্লোগানটিও: ‘জয় শ্রীরাম’।

সে গাছ এত দিনে মহীরুহ। ঢোঁড়াই চরিত মানস-এ ঢোঁড়াই-এর বৌকা বাওয়া মিসিরজির কাছ থেকে শুনেছিল, “অযোধ্যাজীতে রামচন্দ্রজীর মন্দিরটাকে মিয়ারা মসজিদ করে নিয়েছে,” লোকশ্রুতির সেই মন্দিরও প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়ার পথে। ফলে এখনও আস্তিনের তাস টেবিলে ফেলতে দেরি করলে চলে না। দক্ষিণ ভারতের চাপে হিন্দি আগ্রাসনকে আঞ্চলিক ভাষা প্রসারের নামে ঢাকা দিয়ে রেখে, শিক্ষাসংক্রান্ত আর যা যা বিষয় লুকোনো ছিল এত দিন, দাবার ঘুঁটির মতো সব এক সঙ্গে ঢেলে দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে।

ডারউইনকে তুলে দেওয়ার এ-হেন সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারালে সঙ্ঘ পরিবারের ভিতরেই কথা উঠত। মৌলবাদ সাদা কালো সবুজ গেরুয়া যে রঙেরই হোক, ডারউইন থেকে ডকিন্স বা বিবর্তনবাদ সকলেরই সমান শত্রু। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মান্ধতা আর ডারউইন অতি বড় ওস্তাদের হাতেও মেশে না। তালিবান, আইএস-এর কথা বলে কী লাভ, খাস আমেরিকাতেই বহু জায়গায় এখনও ডারউইন পড়ানো হয় নমো-নমো করে। গির্জার ভয়?

ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটছে। বাংলাদেশ ও ভারতে স্কুলে পাঠ্যসূচি থেকে ডারউইন বাদ যাওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রায় একই কার্য-কারণের ফলে। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের আগের যুগে কি ফিরে যাচ্ছি আমরা? সেই কবে, ১৮৫৩ সালে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসাবে ছাত্রদের ভাল ভাল ইংরাজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE