তিমির অবগুণ্ঠনে... 'চৌদভিঁ কা চাঁদ' (১৯৬০)
আনহোনি কো হোনি কর দে, হোনি কো আনহোনি। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি মূলধারার ছবি ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’-তে অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করে ফেলার কথা বলতে চেয়েছিলেন পরিচালক মনমোহন দেশাই। ছবির অন্যতম নায়ক আকবর কাওয়ালি গায়ক। আর তার প্রেমিকার বাবা ঘোরতর সনাতনী মুসলমান। পরিবারের মেয়েদের বোরখা পরিয়ে সে হাজির হয় আকবরের কাওয়ালির আসরে।
বোরখা-ঢাকা সুন্দরীদের সামনে আকবর গান ধরে— ‘পর্দা হ্যায় পর্দা/ পর্দে কে পিছে পর্দানশিঁ হ্যায়/ পর্দানশিঁ কো বে-পর্দা না কর দুঁ তো/ আকবর মেরা নাম নেহিঁ হ্যায়’। অনেক কাওয়ালির মতো এই গানটিকেও দ্ব্যর্থক রেখেছিলেন গীতিকার আনন্দ বক্সী। পর্দানসীন প্রেমিকাকে বে-পর্দা করার প্রতিস্পর্ধার পিছনে ছিল ঐহিকতার পর্দা সরিয়ে আধ্যাত্মিক সত্যদর্শনের আকুতি।
মহম্মদ রফির গাওয়া সেই গানে সে সময় উপমহাদেশ মাত। পর্দানসীনদের বে-পর্দা করার উল্লাস নিয়ে দেশের মুসলমান সমাজও বিশেষ মাথা ঘামায়নি। কারণ, সুফি পরম্পরায় আশিক-মাসুকের মিলনে তো পর্দার ভেদ থাকার কথা নয়! কোনও মৌলবাদ, কোনও ফতোয়া সেই গানের বিরুদ্ধে জারি হয়নি।
সময় বদলেছে। হিজাব, নকাব আর বোরখা ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক বাচনের হাতিয়ার। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই ‘পর্দা’ এমন কিছু মহিমায় উপস্থাপিত, যার নন্দনকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। ইতিহাসবিদেরা দেখাচ্ছেন, ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই পর্দার ব্যবহার প্রচলিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ যে পর্দার প্রচলন ছিল, তা সেই সময়কার বেশ কিছু প্রত্নমূর্তি থেকে জানা যায়। পরে ইহুদি, খ্রিস্টিয় ও ইসলাম— তিনটি সেমিটিক সমাজেই তার প্রচলন বহমান থাকে। অটোমান তুর্কিদের আমলে আভিজাত্য ও উচ্চ রুচিবোধের প্রতীক হিসেবে নকাব, হিজাব ও বোরখার প্রচলন জনপ্রিয় হয়। ‘মুহাজিবা’-রা (হিজাব পরিহিতা নারী) থেকে যান এক দূর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। সুফিবাদ সেই নন্দনতত্ত্বকেই নিয়ে যায় আধ্যাত্মিক স্তরে। পর্দা কেবল সত্য আর বিভ্রমের মাঝখানের ব্যবধান হয়েই থাকেনি, সুফি কবিতায় এবং গানে তা ব্যঞ্জনা পেতে থাকে বিরহীর অন্তর্বেদনার আড়াল এবং একই সঙ্গে শুধু মাত্র পরমের সামনে নিজের অন্তরের সৌন্দর্যকে ব্যক্ত করার প্রতীক হিসেবে। নশ্বর মানুষ সেখানে বাহুল্য, লোকসমাজ সেখানে গৌণ।
ভারতীয় উপমহাদেশের আরবি, ফারসি এবং উর্দু-হিন্দভি-হিন্দি ভাষার কবিকুল একনিষ্ঠ ভাবে বন্দনা করে গিয়েছেন পর্দার। প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের তীব্র মিলনেচ্ছা বা আশিকের সঙ্গে মাসুকের একান্ত মিলনকে ব্যক্ত করতে বারবার উঠে আসে পর্দার প্রসঙ্গ। এই বাধাটুকু অতিক্রম করতে পারলে যে অধরা মাধুরী ছন্দবন্ধনে ধরা দিতে পারে, মূর্ত হয়ে উঠতে পারেন সকল দেখার শ্রেষ্ঠ অ-দৃষ্ট, জাহের (প্রকাশ্য) হয়ে উঠতে পারে বাতুন (গোপ্য)— এমন কথা লিখে গিয়েছেন একের পর এক সুফি দার্শনিক কবিরা। ছাপ-তিলক সব ছেড়ে নয়নে নয়ন মিলিয়ে তাকানোর কথা লিখে গিয়েছেন স্বয়ং আমির খসরু (ত্রয়োদশ শতক)। নকাব সেখানে নেই। লজ্জার কোনও স্থান নেই পরম আর তাঁর মিলনাকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত ভক্তের মাঝখানে। সে দরশনে মিশে যায় কালো যমুনার ছলোচ্ছল ঢেউ, রাধারানির আব্রু, না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে জেগে থাকে ‘কাওয়াল’-এর উচ্চারণ শুধু।
কবিতা যখন সঙ্গীত, কাব্য যখন সুরের জাদুতে বসন-ভূষণহারা, তখন পর্দা কথায়? ১৯ শতকে নিভে-আসা মুঘল রাজসভায় মির্জা গালিবের সামনে প্রজ্জ্বলিত শামাদানের আলোয় ফুটে উঠেছিল ‘বেখুদি বেসবব নহিঁ, গালিব/ কুছ তো হ্যায় জিসকি পর্দহ্কারি হ্যায়’ (‘কারণ বিনা আত্মহারা হইনি, গালিব/ গোপন কিছু আছে এবং তারই জন্য পর্দা খালি’— অনুবাদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)। আত্মবিচ্ছিন্ন সত্তাও জানে এ জগতের উপরে বিছানো রয়েছে পর্দা, কারণ গোপনীয়তার অবকাশ আছে। প্রয়োজন আছে।
গালিব থেকে মজরুহ্ সুলতানপুরি— গোটা উপমহাদেশের নন্দন-বৃত্তে শুধু পর্দা আর পর্দার পরত। কে ভুলবে লতাকণ্ঠে ধ্বনিত ‘বাহোঁ মে চলে আও, হমসে সনম ক্যা পর্দা’ (‘অনামিকা’, ১৯৭৩, সুর রাহুল দেব বর্মণ)! প্রিয় যখন দু’বাহু প্রাসারিত করেন আলিঙ্গনের জন্য, তখন পর্দার আর অর্থ কী? না, তখনও কেউ কণ্ঠ তোলেননি হিজাব বা নকাবের ‘অবমাননা’ নিয়ে। তোলার প্রশ্নই তো নেই!
গজলের পর গজল, নজমের পর নজম লিখে রেখেছে পর্দার আড়ালের অনুন্মোচিত রহস্যের স্বপ্নগুলিকে। রসিক জানেন ‘ইয়ে আজ কা নহিঁ মিলন/ ইয়ে সঙ্গ্ হ্যায় উমর ভরকা’। চিরবিরহ আর অবিচ্ছেদ্য মিলনের অন্তরালে সেতু বাঁধে যে নকাব, তাকে আর এক রূপে দেখেছিলেন কবি আমির মিনাই (১৮২৯-১৯০০)। লখনউয়ের এই কবি লিখতে পেরেছিলেন— ‘সরকতি যায়ে রুখ সে নকাব আহিস্তা আহিস্তা/ নিকলতা আ রহা হ্যায় আফতাব আহিস্তা আহিস্তা’ (রূপ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে আবরণ, ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হচ্ছে সূর্য)।
১৯৮০-র দশকে যে সব যুবকেরা বুকের মধ্যে আগুনভরা জল নিয়ে জগজিৎ-কণ্ঠে এই গজল শুনেছিলেন, তাঁরা জানেন এর অন্তর্বেদনা কোথায়। বিশ্বায়ন আসেনি। সহ-শিক্ষাক্রমের কলেজ ক্যান্টিনে সিগারেটের ঘনিয়ে ওঠা ধোঁয়ায়, গলা বেয়ে নেমে যাওয়া বিস্বাদ চায়ের জ্বলনে দূরের টেবিলে বসে থাকা মেয়েটি ওড়না সামলে নিল। মাথা ঢাকা না থাকলেও ‘আফতাব’ যেন ঝলসে উঠল সেই ঘোলাটে বাল্ব-জ্বলা প্রকোষ্ঠে। টেবিল-দূরত্বে তখন সন্ধে ঘনিয়ে আসছে— ‘শব-এ ফুরকত কা জাগা হুঁ, ফরিস্তো আব তো সো নে দো/ কভি ফুরসত মেঁ কর লে না হিসাব আহিস্তা আহিস্তা’। সেই নিশিযাপন তো আজও বহমান! মধ্যদিনের গান বন্ধ করে দিয়েছে পাখি, আফতাবও ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। আর কত বেদনা উছলে উঠবে!
শুধু মাত্র মাথা থেকে সরে গিয়েছিল নকাব, শুধু মাত্র একবার দেখা গিয়েছিল সেই থিরবিজুরিকে...। তার পর ‘ওহ্ বেদরদি সে সর কাটেঁ আমির অর ম্যাঁয় কহুঁ উন সে/ হুজুর আহিস্তা আহিস্তা, জনাব আহিস্তা’। সমস্ত চৈতন্য সে দিনই উধাও হয়েছে, যে দিন ওই রূপ বে-নকাব হয়ে গিয়েছিল। সেই বেদনা তো শিরশ্ছেদের যন্ত্রণা, যা মুহূর্তে মুক্তি দেয় না। সারাটি জীবৎকাল ধিকিধিকি জ্বালায় ধংস করে প্রেমিককে, আহিস্তা আহিস্তা।
মিনাইয়ের কাব্যে হঠাৎই প্রেমিকা হয়ে গেলেন ‘হুজুর’, ‘জনাব’। তিনিও কি থাকলেন আর সেই টেবিল-দূরত্বের কিশোরীটি হয়ে? নাকি ‘সুন্দর’ নামের এক অনন্যদর্শন স্থির হয়ে রইল জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে?
আবার কখনও জগজিতের কণ্ঠেই উছলে উঠেছে ইবন-এ-ইনশার কাব্য ‘কাল চৌদভিঁ কা রাত থি’। চতুর্দশী চন্দ্রমাকে ম্লান করে দিয়ে সেই ‘তুমি’ যখন উদ্ভাসিত হলে, তখন প্রেমিক, দরশন-পিপাসুও কিন্তু পর্দাকে ‘মঞ্জুর’ করেছিলেন। চৌদভির চাঁদের সেই অসহনীয় সৌন্দর্যকে দেখেছিলেন গুরু দত্ত। ঘুমন্ত ওয়াহিদার মুখ অনাবৃত ছিল। কিন্তু মুদ্রিত নয়ানই তো ‘পর্দা’। ঘুমই সেখানে চন্দ্র-সূর্যের ফারাক লুপ্ত করে দেয় তার অনচ্ছতায়। শাকিল বদাউনির লেখনী আর অনবদ্য ক্যামেরায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল ‘পর্দা’-র আর এক মহিমা। সেই ছবির পোস্টারেও ছিল অবগুণ্ঠনবতীর সামনে বিস্ময়-বিমূঢ় প্রেমিকের সিল্যুয়েট। নাঃ! এ সব কিছু নিছক বিনোদন নয়। ‘এন্টারটেনমেন্ট’ নামের পশ্চিমী অভিধা একে ধারণ করতে পারে না।
১৯৯২-এ ঘটে গেল বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ড। ১৯৯৫-এ মণিরত্নম নিয়ে এলেন ‘বম্বে’। এক মুসলমান মেয়ের সঙ্গে এক হিন্দু উচ্চবর্ণীয় যুবকের প্রেম। সমুদ্রতীরের এক পুরনো কেল্লায় বিরহের তরঙ্গ যখন ফুঁসে উঠছে, তখন বোরখাধারী সেই মেয়ে আসে। কাঁটায় আটকে যায় তার বোরখা। সেই বন্ধন খুলে ফেলে সে এগিয়ে যায় ‘প্রেম’ নামক এক শ্বাশ্বতের দিকে। পর্দা কাঁপছে তখন আল্লারাখা রহমান নামক এক প্রতিভাধরের সুরসৃজনে। ‘তু হি রে... তেরে বিনা ম্যাঁয় ক্যায়সে জিউঁ’। সেই দৃশ্য নিয়ে আপত্তি উঠেছিল কোনও কোনও মহল থেকে। কিন্তু ধোপে টেকেনি সে সব।
১৯৭৭-এ ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’-তে ‘পর্দানশিঁ’-কে বে-পর্দা করার পিছনে কি দায় ছিল জরুরি অবস্থার পরে এক নতুন ভারত গড়ার জন্য মেদুর আবেদনের? আর ‘বম্বে’ কি সেই আবেদনের অসারত্বকেই তুলে ধরেছিল ১৯৯৫-এর স্বপ্নভঙ্গের দিনগুলিতে?
এখন ‘পর্দা’ এক ঘোরতর রাজনৈতিক উচ্চারণ। পক্ষে-বিপক্ষে চাপানউতর। পরলে ‘গেল গেল’ বলে উঠবেন প্রগতিবাদীরা, না পরলে গোসা হবে রক্ষণশীলদের। এর মধ্যে কি কোথাও স্বস্তি নেই?
রাতের আকাশে যখন চতুর্দশীর চাঁদের গায়ে মেঘ এসে ঢেকে দেয়, যখন পৌষের ধানক্ষেতে হালকা কুয়াশার নকাব বিছিয়ে রাখে ভারতবর্ষ নামে এক হতভাগ্য দেশ, তখনও কি শোনা যায় না কম্পিত কন্ঠে এক শ্মশ্রুময় পুরুষের গান— ‘তিমির অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি/ কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী/...রয়েছি বাঁধা বন্ধনে, ছিঁড়িব, যাব বাটে—/ যেন এ বৃথা ক্রন্দনে এ নিশি নাহি কাটে।/ কঠিন বাধা লঙ্ঘনে দিব না আমি ফাঁকি’?
‘নকাব’ না থাকলে সত্য দৃষ্ট হবে কোন পন্থায়? দুঃসময়ের দাপটে ভরসা টলে যায়। তবু অনন্ত জাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy