Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Green Environment

বিরাট বদল এসেছে বিশ্বের হিসেব-নিকেশের ভাবনায়, কিন্তু কাজের কাজ কতটা হবে তাতে

নতুন আর্থিক এবং অর্থনৈতিক হিসাবরক্ষার পদ্ধতির দ্বারা সমর্থিত হয়ে লগ্নিকারীদের কর্মকাণ্ড কি সরকারের তুলনায় ভাল ফল দেবে?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২১ ১০:৩৯
Share: Save:

সংস্থার হিসেব-নিকেশ হয় লাল কালিতে (ক্ষতি) অথবা কালো কালিতে (লাভ) হয়ে থাকে। কিন্তু ইদানীং আরও একটি রং হিসেবের খাতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে— সবুজ। সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিবেশের উপর কী প্রভাব ফেলছে, এই রং তারই দ্যোতক।

এর পিছনে একটি কাহিনি রয়েছে। সেটি এই— চলতি সপ্তাহে বিশ্বের বেশ কিছু বিনিয়োগকারী প্রধান চারটি হিসাবরক্ষক প্রতিষ্ঠানকে (যারা কর্পোরেট জগতের বাঘা বাঘা সংস্থার অডিট করে থাকে) হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে: পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের একত্রে কাজ করতে হবে। নয়তো তাদের দ্বারা বিনিয়োগকৃত সংস্থার অডিট থেকে তারা বঞ্চিত হবে।

ইতিমধ্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থ দাশগুপ্তের মতো অর্থনীতিবিদ এ কথা বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন যে, দেশগুলির জাতীয় হিসেব-নিকেশের (যা থেকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বোঝা যায়) মধ্যে সেই সব অর্থনৈতিক কাজকর্মকেও ধরতে হবে, যা এই গ্রহের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি করছে। এক কথায় তিনি ‘সাসটেনেবিলিটি’ সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন (‘সাসটেনেবিলিটি’-র অর্থ হিসেবে এখানে জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়কে ধরা হয়েছে। যথাক্রমে খাদ্য, প্রাকৃতিক শক্তি, জল, বর্জ্যের ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্র ইত্যাদি)। ব্রিটেনের রাজকোষের জন্য করা এক ‘সমীক্ষা’য় পার্থ জৈব বৈচিত্রের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের (অরণ্য, নদী ইত্যাদি) প্রায় ৪০ শতাংশ ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে মানবিক ক্রিয়াকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় মানুষের টিকে থাকতে গেলে বর্তমান পৃথিবীর ১.৬ গুণ বেশি বড় এক পৃথিবী প্রয়োজন। তাঁর এই হিসেব অর্থনৈতিক ভোগের বর্তমান স্তর ও চরিত্রের দিকে লক্ষ রেখেই করা। আবার ভারতের ভিতরেই এই প্রশ্নটি উস্কে দিয়েছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর উরজিৎ পটেল। তিনি বলেছেন, ব্যাঙ্কের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে প্রকৃতি সংক্রান্ত বিষয়ের কথা মাথায় রেখেই নির্ধারণ করতে হবে।

বিশ্বের প্রধান লগ্নিকারী সংস্থাগুলি ক্রমান্বয়ে বলে চলেছে, যে সব সংস্থা ‘ইএসজি’ (‘এনভায়রনমেন্ট, সোসাইটি এবং গভর্ন্যান্স’ বা পরিবেশ, সমাজ এবং প্রশাসন)-র নীতিগুলি মেনে চলে না, তারা সেখানে বিনিয়োগ করা বন্ধ করে দেবে। গত সপ্তাহে গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত পরিবেশ সম্মেলনে প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীরা তাদের হাতে-থাকা ১৩০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার (আনুমানিক ভাবে বিশ্বপুঁজির প্রায় ৪০ শতাংশ) জলবায়ু পরিবর্তন, জীবাশ্ম-জাত জ্বালানি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত রাখা তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রেখেছে বলে জানিয়েছে।

এ ধরনের অঙ্গীকারকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আগে কিছুটা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ‘গ্রিন অ্যাকাউন্টিং’ (সরল বাংলায়, পরিবেশের কথা মাথায় রেখে হিসেব-নিকেশ) এবং ‘ইএসজি’-বিনিয়োগের হাওয়া অল্প দিন আগেই উঠেছে। কিন্তু তার অগ্রগতি খুবই সামান্য। এর একটি কারণ, কোনও সংস্থাতেই এই বিষয়ে হিসেব-নিকেশের জন্য কোনও সমমাত্রিক পদ্ধতি নির্ধারিত নেই। আরও একটি কারণ এই, মূলধারার অর্থনীতিবিদরা বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কিন্তু এই দু’টি কারণই এই মুহূর্তে বদলের সম্মুখীন।

সুতরাং এই সব উদ্যোগকে দেখতে হবে দেশগুলির সেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার নিরিখে, যার দ্বারা কার্বন নির্গমনের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব উষ্ণায়নকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমায়িত রাখা যায়। তিন বছর আগে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম নর্ডহাউস এক চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, গত ৩০ বছরে অগণিত বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও জিডিপি-র প্রতি এককে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমার হার প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে (প্রতি বছর ১.৮ শতাংশ)। এই সব সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হলেও সম্ভবত পরিসংখ্যানটি একই থাকত।

বিভিন্ন রাষ্ট্র অন্যান্য পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রেও যে উজ্জ্বল ছবি দেখাতে পারবে, এমন নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ‘কার্বন’ (কার্বন সংক্রান্ত কর)-এর হিসেব কষে নির্ধারণ করে টন প্রতি দুই আমেরিকান ডলার। নর্ডহাউস হিসেব কষে দেখাচ্ছেন যে, এই পরিমাণ যদি ৫০ ডলারও করা যায় (তাঁর মতে, কয়লা-জাত বিদ্যুতের দাম এর ফলে দ্বিগুণ হয়ে যাবে), তাতেও কাজের কাজ হবে না। এবং সমমাত্রিক ভাবে চালু করা কোনও করই পরিবেশের প্রতি সুবিচারের পথ প্রশস্ত করবে না। মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া এবং উৎকর্ষ পটেল ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনমিক প্রগ্রেস’-এ প্রদত্ত এক গবেষণাপত্রে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের তরফে এক ন্যূনতম মূল্যমানের প্রস্তাব রেখেছেন। তাঁদের মতে ভারতের পক্ষে ২৫ ডলারের কার্বন কর হবে বিশ্বের ধনীতম দেশগুলির কার্বন করের এক-তৃতীয়াংশ। এতেও কিন্তু কয়লা-জাত বিদ্যুতের দামে ২৭ থেকে ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে। যেহেতু ভারতে বিদ্যুৎ ইতিমধ্যেই ভর্তুকিপ্রাপ্ত, এমন মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে আর মুখ না খোলাই ভাল।

এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সর্বাগ্রে এই প্রশ্ন জাগে যে, নতুন আর্থিক এবং অর্থনৈতিক হিসাবরক্ষার পদ্ধতির দ্বারা সমর্থিত হয়ে লগ্নিকারীদের কর্মকাণ্ড কি সরকারের তুলনায় ভাল ফল দেবে? বিশেষত, জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত যে অভিজ্ঞতা ও সচেতনতা সাম্প্রতিক সময়ে ধনী দেশগুলিতে গড়ে উঠেছে, তা কোন দিকে নিয়ে যাবে? যদি আপনি আশঙ্কা করেন যে, আপনার বাড়িটি দাবানলে দগ্ধ হয়ে যেতে পারে, তা হলে আপনি অন্য ক্ষেত্রগুলির তুলনায় ‘ইএসজি’ ক্ষেত্রে আপনার অর্থ অধিকতর মাত্রায় বিনিয়োগ করতে রাজি হবেন। এবং যদি আপনার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প তার প্রয়োজনীয় পুঁজি টানতে ব্যর্থ হয়, তা হলে আপনি সেই ইচ্ছা ত্যাগ করবেন।

সুতরাং আমরা সকলেই জানি যে, বিনিয়োগকারী এবং হিসেব-নিকেশের নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক অর্থনীতিবিদরা বা হিসাব পরীক্ষকরা সূক্ষ্ম বিচারে এক চুল এ দিক ও দিক করবেন মাত্র। সেটিকে আপনি ‘দ্বিতীয় পন্থা’ বা ‘দ্বিতীয় পরিবর্ত’ বলতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন, এর কোনও ‘তৃতীয় পরিবর্ত’ বা ‘পন্থা’ কিন্তু নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Green Environment Carbon Emmission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE