একদিকে পণ্য আর অন্যদিকে বিনিময়ের মাধ্যমও হয়ে ওঠে ক্রিপ্টোকারেন্সি। প্রতীকী ছবি।
ফোন ভরা টাকা! ম্যানি ব্যাগের বাজার এখন দিন গুনছে। মনে হতেই পারে বাড়াবাড়ি। কিন্তু ঘটনা হল, শুধু ভারত নয়, বিশ্বজুড়েই এখন চর্চা চলছে কাগজের নোট থেকে ডিজিটাল মুদ্রাকে লেনদেনের মাধ্যম করে তোলা যায় কী ভাবে। পরিবর্তনটা বৈপ্লবিক। বিনিময়ের পথ ছেড়ে লেনদেনের মাধ্যম যখন মুদ্রা হল, ঠিক তার মতোই। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এই পরিবর্তনটা অত সহজ নয়। কারণ, বিশ্বজুড়ে লেনদেনের যে নীতি তৈরি হয়েছে তা এখন আমাদের মজ্জায়। বিশ্ব বাজারও পরস্পরের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে লেনদেনও হারিয়েছে তার শুরুর সত্তা। এই রাস্তায় হেঁটে গোটা বিশ্বকে ই-মুদ্রায় বেঁধে ফেলার কাজটাও কিন্তু তাই অত সহজ নয়। এই জন্যই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলি এখন গভীর আলোচনায় মগ্ন। শুরু হয়েছে গবেষণা। নীতি নিয়ে। যাতে লেনদেনের ঐতিহ্য বজায় রেখেও নতুন দুনিয়ার নতুন বিনিময় মাধ্যমকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করে নেওয়া যায়।
জগত কিন্তু থেমে নেই। বাজারে বিট কয়েনের মতো ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে চালু হয়ে যায় তার ব্যবহার। আবার যেহেতু এর জোগান সীমিত তাই সোনার মতোই লোকে এতে বিনিয়োগও করতে শুরু করে। একদিকে পণ্য আর অন্যদিকে বিনিময়ের মাধ্যমও হয়ে ওঠে ক্রিপ্টোকারেন্সি। এবং পুরোটাই ঘটে কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে। চোরা চালান থেকে বেআইনি অস্ত্র বাজারের লেনদেনের মাধ্যম হয়ে ওঠে সভ্যতার নতুন প্রযুক্তির জঠরে জন্মানো এই মুদ্রার। একটা সময়ে সব দেশের মুদ্রার দামও ওঠা পড়া করত সোনার সঙ্গে। একটি মুদ্রার পিছনে কতটা সোনা আছে তা দিয়ে নির্ধারিত হত তার বিনিময় মূল্য। সময়ের সঙ্গে তাও বদলে যায়। এবং মুদ্রার মূল্যও নির্ধারিত হওয়া শুরু করে সেই দেশের আর্থিক বৈভবের ভিত্তিতে।
কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ক্রিপ্টোর পিছনে থাকে শুধুই জটিল অঙ্ক সমাধানের ক্ষমতা। প্রতিটি সমাধান জন্ম দেয় একটি বা একাধিক ক্রিপ্টোর। যাকে বলে মাইনিং। পুরোটাই মেধাভিত্তিক। তা দুষ্টু না উপকারী সে আলোচনার পরিসর অন্য। কিন্তু এই মুদ্রা জনপ্রিয় হতে শুরু করায় বিপদের আঁচ বাড়তে থাকে। আর তার ফলে শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলি ভাবতে শুরু করে ই-মুদ্রার কথা। কিন্তু আজকের ডিজিটাল দুনিয়া বিশ্বের মেধাকে এক মঞ্চে এক লহমায় টানতে পারে। ক্রিপ্টোর পিছনে কোনও সম্পদ না থাকার যে ঝুঁকি আছে তা মেটাতে বাজারে চলে আসে ‘স্টেবল কয়েন’। বাংলায় যাকে সুস্থিত ই-মুদ্রা বলতে পারি। এই মুদ্রার মূল্য নির্ভর করে সোনা বা ডলারের দামের উপর। তাই এর দামের ঝুঁকি অনেক কম।আর নীতি নির্ধারকদের কাছে এখন এটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ই-মুদ্রায় লেনদেনের খরচ কম। কিন্তু তাকে চলতি সব আইনে বিরাট কোনও পরিবর্তন না করেই চালু করার পদ্ধতি তৈরি করাটাই এখন বিশ্বজুড়ে নীতি নির্ধারকদের কাছে একটা বিরাট সমস্যা।
সহজ করে বোঝার মধ্যে অনেক সমস্যা থাকে। কারণ, সহজ করে বোঝার রাস্তায় হাঁটলে অনেক জটিলতাকে বাদ দিয়ে মোদ্দা কথাটা বলে ফেলতে হয়। আর তাতে তৈরি হয় অনেক ফাঁক ফোঁকর। কিন্তু এই চাপটা নিয়েই না হয় আমরা এগোই।বিশ্বজুড়ে ই-মুদ্রা চালু করার আলোচনায় প্রথমেই যেটা উঠে আসছে তা হল ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। প্রথমত, নোট যখন লেনদেনের মাধ্যম, তখন কোন নোট আপনার পকেট থেকে আমার পকেটে এল তা আগে থেকে নোটের নম্বর লিখে না রাখলে খোঁজ রাখা অসম্ভব। এমনকি, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে লেনদেন করলে একে অপরকে কত টাকা দিল তার খোঁজ মিললেও সে টাকা কোনও অস্ত্র ব্যবসায়ীর হাতে গিয়ে পড়ল শেষে গিয়ে তা বার করা সম্ভব নয়। কিন্তু ই-মুদ্রার ক্ষেত্রে একটি মুদ্রা কার কাছ থেকে কার হাত ঘুরে কার কাছে গেলে তা কিন্তু বার করে ফেলা সহজ।
ভারতে ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে সাধারণ মানুষ কতটা উদ্বিগ্ন তা বলা মুশকিল, কিন্তু পশ্চিমী দুনিয়ায় ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে মনে করলে সরকারের অস্তিত্বের উপর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে যায়। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারের প্রেক্ষিতে ই-মুদ্রায় লেনদেন করতে গেলে নানা আইনি পরিবর্তন করার প্রয়োজন। আর এটা কিন্তু একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, এখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ব্যাঙ্ক মারফত নগদ পাঠাতে গেলে খরচ বাবদ অনেক টাকা কেটে নেওয়া হয়। ই-মুদ্রা পাঠালে এই খরচটা আর লাগবে না। কারণ, এখানে তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন থাকবে না। তাই এক দিকে রয়েছে লেনদেনের সুবিধা, অন্যদিকে সেই সুবিধাকে সাধারণ নাগরিকের হাতে তুলে দেওয়ার পথে কাঁটা হয়ে রয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন দেশের ‘বোধের’ ফারাক। রয়েছে আরও একটা সমস্যা। ই-মুদ্রা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নির্ভর নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে নগদ পাঠানোর সমস্যা রয়েছে, অথবা কোনও ব্যাঙ্কের শাখাই কাছাকাছি নেই, সেই রকম ভৌগোলিক অবস্থানেও নাগরিকের হাতে টাকা পাঠানো সম্ভব যা নগদে তাঁকে তোষকের তলায় লুকিয় রাখতে হবে না। কিন্তু এর ব্যবহার জনপ্রিয় করে তুলতে গেলে প্রয়োজন স্মার্ট ফোন এবং তার ব্যবহারের জন্য ন্যূনতম শিক্ষা। এবং স্মার্ট ফোন কেনার ক্ষমতা।
আসলে নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে টাকা ব্যবহারের এমন প্রযুক্তি যা আমাদের সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠবে তার আইনি অনুমোদন প্রক্রিয়াটি সহজ নয়। ভারতের চলতি আইনের সঙ্গে মিলিয়ে প্রথাগত কাগুজে নোটের প্রতিস্পর্ধী প্রক্রিয়া যাতে না হয় তা দেখাই এখন নীতি নির্ধাকদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ভারতে যেমন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ধাপে ধাপে এগোচ্ছে, তেমনই এগোচ্ছে অন্যান্য দেশও। তবে আগামী দিনের লেনদেনের ভবিতব্য যে নির্ধারিত তা নিয়ে সংশয় নেই। কবে তা সর্বজনীন হয়ে উঠবে এখন প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy