শোনা যায়, শাসন করা তাহারেই সাজে, যে সোহাগ করে। ঘুরাইয়া বলা যায়, সোহাগ করাও তাহারেই সাজে, যে মাঝে মাঝেই শাসন করে। কয়েক দিন আগে আরামবাগের বাজুয়া গ্রামে বহু মহিলা ক্রোধান্বিতা হইয়া প্রায় পনেরোটি চোলাইয়ের ঠেক ধ্বংস করিলেন ও কয়েক জন নিজ নিজ স্বামীদের ধরিয়া লইয়া পার্শ্ববর্তী পুষ্করিণীতে চুবাইয়া দিলেন। এই ধরনের বহু গ্রামেই, পুরুষদের নেশা করিয়া চুর হওয়া এক দৈনন্দিন নিয়ম, তাহার পর গৃহে ফিরিয়া অশান্তি বাধাইয়া নেশার ষোলো কলা উদযাপনও সমানে চলিতে থাকে। অর্থ, সামর্থ্য ও শান্তির এই নিরন্তর বিনষ্টি দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়া এক দিন লাঠিগাছা লইয়া বাহির হইয়া পড়া অস্বাভাবিক নহে। আর তাহার সদ্ব্যবহার করিতে গিয়া যদি দেখা যায়, ঠেকের মালিকগণ শনশন চম্পট দিতেছে কিন্তু নেশাতুর ভোক্তাগণ তুরীয় অবস্থায় থম মারিয়া আছেন, তখন তাঁহাদের শিক্ষা দিবার তীব্র অভিপ্রায় সহসা জাগ্রত হইলে, তাহাকে অনুচিত বলা কঠিন। কেহ বলিতেই পারেন, মানুষকে ঘাড়ে ধরিয়া লইয়া গিয়া জলে চুবাইয়া দেওয়া তাহার স্বাধীনতার পরিপন্থী, কিন্তু এই শাসনের মধ্যে রহিয়াছে অনেকটা স্নেহ, বহু বার নিষেধ করিবার পরেও প্রিয়জন বিপথে যাইবার অসহায়তা, প্রকৃত উপকারের আকাঙ্ক্ষা, এবং অবশ্যই শাস্তি দিবার বাসনা। এইগুলি দাম্পত্যের দৈনন্দিন উপাদান। আমাদের সমাজে দম্পতির প্রকাশ্য ব্যবহারে প্রীতি অপেক্ষা সংশোধনী বকুনির প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে এই অভিভাবকত্ব চূড়ান্ত আকার ধারণ করিয়াছে।
দণ্ডটির মধ্যে কর্কশতার তুলনায় মাধুর্য অধিক। গোমাংস খাইবার সন্দেহে একটি মানুষকে অনেকে মিলিয়া হত্যার যে কুশ্রীতা, সেই প্রবণতার মধ্যে দমন বা আঘাতের যে বাঞ্ছা, তাহার কণামাত্রও ইহাতে নাই। জলে চুবাইয়া দিবার মধ্যে এক প্রকারের বাধ্যতামূলক স্নান ও কলুষমার্জনেরই দ্যোতনা প্রবাহিত। মনে রাখিতে হইবে, দ্বিপ্রহরে প্রখর দাবদাহে জলক্রীড়া কিছু মন্দ বিলাস নহে। ইহাতেও সন্দেহ নাই, বেশ কিছু দিন ঠেকগুলি গড়িয়া উঠিতে এবং লোকগুলি সেই ঠেকের পানে পা বাড়াইতে ইতস্তত করিবে। একটি বাধ্যতামূলক প্রক্ষালনে অবশ্যই নেশালিপ্সা উবিয়া যাইবে না, এবং সচেতনতা বৃদ্ধিই এই আপদ দূর করিবার যথাযথ উপায়, কিন্তু মাঝেমধ্যে ওই পুঁথিগত পদ্ধতিগুলি ছাড়িয়া কাঁচা প্রবৃত্তিতাড়িত প্রক্রিয়ার শরণ লইলে, পরিণাম খারাপ হয় না। হলিউড ছবিতে ‘গুড কপ, ব্যাড কপ’ বলিয়া একটি তত্ত্ব চলে, অপরাধীকে এক জন পুলিশ অতি দুর্ব্যবহার করিয়া ধমকাইয়া কাতর করিয়া তুলেন, অন্য পুলিশ ভদ্র নম্র ব্যবহার করিয়া ক্ষতে প্রলেপ দেন, হয় ভয় পাইয়া নয় অপ্রত্যাশিত দয়ায় গলিয়া যাইয়া অপরাধী সকল কথা কবুল করিয়া লয়। তেমনই, সচেতনতার জাঠা বাহির হউক, টিভিতে প্রচার চলুক, তাহার সহিত মাঝেমধ্যে এই জলে মাথা ডুবাইয়া নেশা ছাড়াইবার পালাও চলুক। সাধারণত নরমে ও গরমেই বাস্তব মীমাংসাগুলি সাধিত হয়। উচ্চ তত্ত্বের নিবন্ধ পড়িয়া নেশাগ্রস্ত স্বামীর প্রহারের দাগগুলি সহজে উঠিয়া যায় না। তাই কখনও হস্তে ঝাঁটা ধরিতে হয়। উপরন্তু, এই নীতিবাদের কালে ইহাকে নারীশক্তির অভিনব উত্থান বলিয়াও চালানো যাইতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy