বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ঘিরে ধোঁয়াশা আরও ঘন।
আরও জটিল জট, আরও মেঘাচ্ছন্ন গ্রামবাংলার আকাশ। একটা নির্বাচন এতখানি সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠতে পারে, সে ধারণা বঙ্গবাসীর ছিল না একেবারেই। কারণ এর আগে কোনও নির্বাচনকে ঘিরে এত ঘাত-প্রতিঘাত, এত অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, এত মামলা-মোকদ্দমা দেখেনি বাংলা। আজ কলকাতা হাইকোর্টের জানানোর কথা, ১৪ মে ভোট হবে কি না। কিন্তু বিবাদ গড়িয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত ফের ইতিমধ্যেই। ফলে হাইকোর্ট আদৌ রায় দিতে চাইবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর। অতএব বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ঘিরে ধোঁয়াশা আরও ঘন।
ক্ষমতা বড় অদ্ভুত বস্তু। ক্ষমতা বড় অহঙ্কারী, সে দৃষ্টিশক্তিকে কিছুটা দুর্বল করে দেয় সম্ভবত, চোখের সামনে পর্দা পড়ে যায় নানা রঙের। বাস্তবের আসল রঙ-রূপ চোখে পড়ে না বোধ হয় ক্ষমতার অলিন্দ থেকে। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার ইচ্ছা জাগে, স্বয়ম্ভূ-সুলভ অনুভূতি আসে মনে। নজরে পড়ে শুধুমাত্র কাঙ্খিত গন্তব্য। প্রকৃত অবস্থান আর কাঙ্খিত গন্তব্যের দূরত্ব কতখানি, মাঝে কী কী বাধা রয়েছে, বাধাগুলো কতটা বড়— নজরেই আসে না বোধ হয় সে সব, ঝাপসা হয়ে যায় সব কিছু। তাই গন্তব্যে পৌঁছনোর পথে যা কিছু ঘটছে, সে সব নৈতিক, নাকি অনৈতিক, তা নিয়েও হয়ত ভাবতে ইচ্ছা করে না।
কিন্তু ভারত কোনও একনায়কতান্ত্রিক দেশ নয়। ভারত স্বৈরাচারে শাসিত নয়। ভারত হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এ দেশে গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তটা এমনই যে, রাষ্ট্রের কোনও স্তম্ভ যদি নিজের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন না করে, তা হলে অন্য কোনও স্তম্ভে গিয়ে সে অনিয়ম বাধা পেয়ে যাবেই। আগেও বহু বার সে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে আবার প্রমাণিত হচ্ছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
একটা নির্বাচন কমিশন রয়েছে, একটা সরকার সক্রিয় রয়েছে, একটা বিচারালয় রয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন নামক বলটি একবার এঁর কোর্ট থেকে ওঁর কোর্টে, তার পর ওঁর কোর্ট থেকে তাঁর কোর্টে, ফের তাঁর কোর্ট থেকে এঁর কোর্টে ঘোরাফেরা করছে। সমাধান কী ভাবে হবে, জট কোন পথে কাটবে, এত কোর্টে ঘুরেও তার কোনও দিশা দেখা যাচ্ছে না। এই অচলাবস্থার দায় কিন্তু সর্বাগ্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের, তার পরে রাজ্য প্রশাসনের। এ কথা এই প্রথম বার লিখতে হচ্ছে তা নয়। আগেও লিখতে হয়েছে এ কথা, সাংবিধানিক স্তম্ভগুলিকে মনে করিয়ে দিতে হয়েছে তাদের কর্তব্যের কথা। কিন্তু ফল যে হয়নি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি দেখলেই সে কথা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাই আবার লিখতে হচ্ছে একই কথা।
এমন এক নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা, যে নির্বাচনে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্দিষ্ট হওয়ার আগেই স্থির হয়ে গিয়েছে যে, কয়েক কোটি ভোটদাতাকে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই হবে না। ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ এখনও রয়েছে যাঁদের সামনে, তাঁরা নিশ্চিত নন যে ভোট গ্রহণের তারিখেও তাঁদের সকলের সামনে এই সুযোগ থাকবে কি না। সন্ত্রাস কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বেই তা বোঝা হয়ে গিয়েছে। বাধা না পেলে ভোটগ্রহণ পর্বে তা যে আরও মারাত্মক চেহারা নেবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই ভোটের দিন উপযুক্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা অত্যন্ত জরুরি। এই বন্দোবস্ত আদৌ হচ্ছে কি না জানতে চাইছে আদালত। সদুত্তর দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই দেখাচ্ছে না রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন। ফলে এখনও জানা যাচ্ছে না, কবে হবে ভোট।
নিরাপত্তার প্রশ্নে অঙ্কের খেলা খেলতে চাইছে রাজ্য প্রশাসন। সংখ্যার ধাঁধা আর হিসেবের মায়াজাল তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক একটি দফায় ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছিল। এ বার এক দফায় ৭১ হাজার ৫০০ সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন করা হবে বলে প্রশাসন জানাচ্ছে। গত নির্বাচনের চেয়ে এ বার সশস্ত্র রক্ষীর সংখ্যা বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। গত নির্বাচন যে পাঁচ দফায় হয়েছিল, পঞ্চান্ন থেকে ষাট হাজার সশস্ত্র রক্ষীকে গড়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বুথে মোতায়েন করা হয়েছিল, সে তথ্য অনুল্লিখিত রাখা হচ্ছে। হিসেবের এই কারচুপি বা অঙ্কের এই খেলা যে অত্যন্ত সহজেই আদালতে ধরা পড়ে যাবে, নিজে অন্ধ হয়ে থাকলে যে প্রলয় বন্ধ থাকবে না সে কথা সরকারের বোঝা উচিত ছিল।
নির্বাচন নির্বিঘ্নে করাতে না পারা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত তো হবেই। এই নির্বাচনে কমিশনের সহযোগী যেহেতু রাজ্য সরকার সেহেতু ব্যর্থতার দাগ সরকারের গায়েও লাগবে। শাসক দল নিজের সংগঠন এবং জনভিত্তি সম্পর্কে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। কথায়-বার্তায়-হুঙ্কারে-অলঙ্কারে তেমনটাই প্রতীত হয়। তা হলে সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন করানোর প্রশ্নে এত অনীহা কেন? আদালতও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে এবং প্রশ্ন তুলছে। তা সত্ত্বেও কমিশন বা প্রশাসন নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা যেন ভাবতেই পারছে না। এই আচরণ দুর্বোধ্য। অতএব নির্বাচনের ভবিষ্যতও আপাতত দুর্বোধ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy