তীব্র দহনে গরমের ছুটির আগমন বার্তাটি এই পোড়া দেশে চিরকালই বড় স্বস্তিদায়ক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাহিরে এই এক মাসব্যাপী দীর্ঘ নিশ্চিন্ত অবসরটির খোঁজ বিশেষ মেলে না, তাহা লইয়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত নাগরিকদের ক্ষোভও বিস্তর। কিন্তু সেই পরম কাঙ্ক্ষিত গ্রীষ্মাবকাশও যে কী পরিমাণে অশান্তি ডাকিয়া আনিতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ তাহা প্রমাণ করিল। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এবং অত্যধিক গরমের কারণ দেখাইয়া রাজ্য সরকার সরকারি এবং সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে গরমের ছুটিকে টানিয়া প্রায় দুই মাস করিয়াছে। স্কুলশিক্ষা দফতরের নূতন নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই দুই মাস গোটা স্কুলের ছুটি। অর্থাৎ, পড়ুয়া, শিক্ষক, পঠনপাঠন, মিড-ডে মিল— সবারই অবকাশ।
সুতরাং আশঙ্কা ঘনাইয়াছে। এমনিতেই বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির দাপটে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার হাল শোচনীয়। পঠনপাঠনের মান তলানিতে। তাহার উপর প্রায় এক মাস অতিরিক্ত ছুটির ধাক্কা! বাড়তি ক্লাস লইয়া এই ক্ষতির পূরণ অসম্ভব। সমস্ত স্তরেই বহু শিক্ষক পদ খালি এবং নূতন নিয়োগও বন্ধ। এই সমস্যার কথা সরকারের মাথায় না আসিলেও শিক্ষক হইতে পড়ুয়া সকলেই তাহা অনুধাবন করিয়াছেন। সেই কারণেই কোথাও অভিভাবকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছেন, কোথাও পড়ুয়ারা বারান্দায় ক্লাস করিতে চাহিয়াছে। বস্তুত, প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক পড়ুয়াই পড়াশোনার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে বিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল। এত দীর্ঘ ছুটিতে তাহাদের পড়াশোনার সর্বনাশ হইবে। স্কুলছুটের সংখ্যাবৃদ্ধিও অস্বাভাবিক নহে। সমস্যা আরও। মিড-ডে মিল প্রকল্পের কী হইবে? ইহার সঙ্গে শিশুর পুষ্টির প্রশ্নটি জড়িত। একবেলা ভরপেট খাবারের জন্যও অনেক অভিভাবক তাঁহাদের সন্তানটিকে প্রত্যহ বিদ্যালয়ে পাঠান। ঘোষণার পূর্বে ভাবা হয় নাই শিশুর পুষ্টির কথা। অথবা, পঠনপাঠন এবং পুষ্টি— এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ঢের উপরে স্থান দেওয়া হইয়াছে জনমোহিনী রাজনীতিকে। ভাবা হইয়াছে, ডিএ এবং সরকারি শিক্ষার করুণ হাল সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা ছুটির আনন্দে চাপা পড়িয়া যাইবে।
এমন ভাবনা চূড়ান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়। ইতিপূর্বে কখনও কোনও অজুহাতে এমন দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশের নির্দেশ আসে নাই। এই বৎসর হঠাৎ ব্যতিক্রম কেন? শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করিলে তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চটিতেছেন। সন্দেহ হয়, তাঁহার মগজেও আমবাঙালির কর্মবিমুখতার ব্যাধিটি বাসা বাঁধিয়াছে। যে ব্যাধিকে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হইয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারাইবার শপথ লইয়াছিলেন। তাহা সম্পূর্ণ ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। সত্য, তাঁহার আমলে বঙ্গের কর্মনাশা বন্ধ-সংস্কৃতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসিয়াছে। কিন্তু বাংলায় যে অকারণ ছুটির বন্যা তিনি বহাইয়াছেন, তাহাতে গোটাকতক বনধের দিন রক্ষা পাইলেও সামগ্রিক কাজকর্মের ছবিটি করুণতর হইয়াছে। সরকারের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকেই ইহার দায় লইতে হইবে। রাজ্যে লোকসভা নির্বাচন চলিতেছে। নির্দেশের আশু পরিবর্তন হইবার সম্ভাবনা কম। শিক্ষামন্ত্রীর উপর ভরসা নাই। একমাত্র আশা, নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করিবেন এবং গরমের ছুটি পূর্বনির্ধারিত দিনে শেষ হইবে। আপৎকালীন ছুটির কথা পরে ভাবা যাইবে। আপাতত অকারণ ছুটির খপ্পর হইতে শিক্ষা তো বাঁচুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy