Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বারণাবত

ক্লায়েন্টেলিজম ভিন্ন আর উপায়ও আছে কি? অভিজ্ঞ জনেরা সাক্ষ্য দিবেন, প্রায় সব বাজারেই এমন অনেক বিক্রেতা আছেন, যাঁহাদের সেই বাজারে বসিবার কোনও আইনি অধিকার নাই।

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আরও একটি অগ্নিকাণ্ডে আরও একটি বাজার পুড়িয়া গেল। আরও অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হইলেন। আরও এক বার জানা গেল, তাঁহাদের কোনও বিমা ছিল না। অর্থাৎ, তাঁহারা সকল লইয়া সর্বনাশের— আশায় না হউক, আশঙ্কায়— বসিয়া ছিলেন। যেমন, আরও অজস্র বাজারে আরও অজস্র ব্যবসায়ী বসিয়া আছেন। কেন তাঁহাদের দোকানের বিমা নাই, তাহার একটি কারণ— অন্তত তিন দিকে পাকা দেওয়াল ঘেরা না হইলে কোনও পরিসরকে বিমা সংস্থাগুলি ‘দোকান’ বলিয়া মানিতে নারাজ। এবং, ‘দোকান’ না হইলে তাহার বিমাও নাই। কিন্তু, বিমা না থাকিবার ইহাই একমাত্র কারণ নহে। খোঁজ করিলেই জানা যায়, আইনানুগ ভাবে ব্যবসা চালাইতে হইলে ন্যূনতম যে কাগজপত্রগুলি প্রয়োজন হয়, বহু ব্যবসায়ীরই তাহা নাই। ব্যবসা চলিতেছে, কারণ রাজনৈতিক আশীর্বাদ আছে। নেতাদের আনুকূল্যে প্রশাসনের নিকট জবাবদিহি না করিয়াও ব্যবসা চালাইয়া যাওয়া যায়। এই আগুনগুলি এক অর্থে সেই ক্লায়েন্টেলিজম-এরই আগুন। তাহার কল্যাণে বেনিয়মগুলি ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা না হইলে, প্রশাসন নিজের দায়িত্ব পালন করিলে, হয়তো আগুন লাগিতই না। অন্তত, এত বার, এতগুলি জায়গায়, লাগিত না।

প্রশ্ন উঠিবে, ক্লায়েন্টেলিজম ভিন্ন আর উপায়ও আছে কি? অভিজ্ঞ জনেরা সাক্ষ্য দিবেন, প্রায় সব বাজারেই এমন অনেক বিক্রেতা আছেন, যাঁহাদের সেই বাজারে বসিবার কোনও আইনি অধিকার নাই। একটি জায়গায় বসিতে বসিতে যেটুকু অধিকার জন্মে, তাহাই ভরসা। কঠোর আইনের পথে হাঁটিতে হইলে সেই লোকগুলিকে উঠাইয়া দিতে হয়, যাহাতে তাঁহাদের জীবিকা অর্জনের আর কোনও সুযোগই থাকে না। রাজনীতির চোরা গলি তাঁহাদের সেই জীবিকার অধিকার দেয়। আপত্তিটি আংশিক ভাবে মানবিক, কিন্তু যুক্তিহীন। উচ্ছেদ একটি চরম পন্থা— তাহার পূর্বে অনেক দফায় সুযোগ দেওয়া সম্ভব। কিছু অর্থের বিনিময়ে ব্যবসাটিকে আইনসিদ্ধ করিবার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া চলে। পাকা দোকানঘর যদি বিমার আবশ্যিক শর্ত হয়, তবে সহজ কিস্তিতে তাহারও ব্যবস্থা করা চলে। তাহাতে রাজনীতির স্বার্থও ক্ষুণ্ণ হইবে না। অব্যবস্থার প্রকৃত কারণটি হইল ‘পাথ ডিপেন্ডেন্সি’— যেমনটা হইয়া আসিতেছে, সেই পথেই চলিতে থাকা। সেই ব্যবস্থায় বিপদের প্রকৃত ঝুঁকি কতখানি, মানুষও তাহা বুঝিতে পারে না। অতএব, বারণাবতই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।

এই স্থিতাবস্থাকে ভাঙিবার দায়িত্ব কাহার? প্রথম দায়িত্ব রাজনীতিকদের। ক্লায়েন্টেলিজমের যে পথ তাঁহারা বাছিয়া লইয়াছেন, তাহা পরিহার করিতে হইবে। রাজনীতির স্বার্থেই এই মানুষগুলির রুজিরুটির কথা তাঁহাদের ভাবিতে হয়— এই বাস্তবটি অস্বীকার করিবার কোনও অর্থ নাই। কিন্তু, আইনকে অস্বীকার করিয়া সেই পথে হাঁটা চলিবে না। কীভাবে এই মানুষগুলির জীবিকাকে আইনসিদ্ধ করিয়া তোলা যায়, তাহার কথা ভাবিতেই হইবে। দায়িত্ব প্রশাসনেরও। যে বাজার পুরসভার অধীন, সেখানে আইন এবং সুরক্ষাবিধির কোনও তোয়াক্কা না করিয়াই ব্যবসা চলিতেছে, এবং পুরসভা তাহার নীরব সাক্ষী— এমনটা হইতে পারে না। ব্যবসায়ীরা যাহাতে প্রয়োজনীয় নথিপত্র করাইয়া লন, বিমা কেনেন, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব পুরসভাগুলিকেই লইতে হইবে। তাঁহারা ব্যবসায়ীদের একাধিক সুযোগ দিন, সামর্থ্যে কুলাইলে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ভাবে সহায়তা করুন। কিন্তু, বহু সুযোগেও যাঁহারা এই কাজগুলি করিয়া লইতে ব্যর্থ হইবেন, তাঁহাদের প্রতি কঠোর হওয়াই বিধেয়। বারুদের স্তূপের উপর নির্বিকার চিত্তে বসিয়া থাকা প্রশাসনের কাজ হইতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government Fire case Market Insurance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE