Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আগে কাশ্মীরের মানুষের কথা শুনুন

কা শ্মীর জ্বলছে। সৈ য়দ আলি শাহ গিলানি দরজা খোলেননি। নয়াদিল্লির নেতারা সর্বদল বৈঠক করতে শ্রীনগরে যাওয়া ইস্তক চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে ওই দরজার দিকে চেয়ে ছিল তামাম কাশ্মীর। তার আগে বেশ কয়েক দিন ধরে গ্রামগ্রামান্তর থেকে বাস ধরে, ভাড়া গাড়িতে তরুণেরা ছোট-ছোট দলে এসেছেন ওই দরজার সামনে।

‘৯/১১’। পুলিশের গুলিতে নিহত জাভেদ আহমদ দর-এর অন্ত্যেষ্টিতে। শ্রীনগর। ১১ সেপ্টেম্বর। এএফপি

‘৯/১১’। পুলিশের গুলিতে নিহত জাভেদ আহমদ দর-এর অন্ত্যেষ্টিতে। শ্রীনগর। ১১ সেপ্টেম্বর। এএফপি

সোমেশ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কা শ্মীর জ্বলছে। সৈ য়দ আলি শাহ গিলানি দরজা খোলেননি। নয়াদিল্লির নেতারা সর্বদল বৈঠক করতে শ্রীনগরে যাওয়া ইস্তক চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে ওই দরজার দিকে চেয়ে ছিল তামাম কাশ্মীর। তার আগে বেশ কয়েক দিন ধরে গ্রামগ্রামান্তর থেকে বাস ধরে, ভাড়া গাড়িতে তরুণেরা ছোট-ছোট দলে এসেছেন ওই দরজার সামনে। একটাই আর্জি, ‘‘গিলানি সাব যেন ভারতের চাপের কাছে মাথা না নোয়ান।’’

নয়াদিল্লি মানুক বা না মানুক, ছিয়াশি বছরের এই পাকিস্তানপন্থী হুরিয়ত নেতাকেই পিতৃসমান বলে মনে করেন কাশ্মীরিদের একটা বিরাট অংশ। তিরিশের দশকে যাঁর নেতৃত্বে কাশ্মীরি স্বাধিকারের স্বপ্ন ডানা মেলে, সেই শেখ আবদুল্লার পরে এই জায়গা আর কাউকে কখনও দেয়নি ভূস্বর্গ। ছেলেগুলো তাই বলতে এসেছিল, ‘‘গিলানি সাবকে বলবেন, ওঁর কথা আমরা ফেলতে চাই না। কিন্তু তিনি যদি ভারতের ফাঁদে পা দেন, তা আমরা মানতে পারব না।’’

গিলানির এই প্রত্যাখ্যানের পিছনে পাকিস্তানের হাত দেখছেন দিল্লির কর্ণধারেরা। সত্যিই তো, পাকিস্তান তো আছেই বহু কিছুর নেপথ্যে। কাশ্মীরের শেষ স্বাধীন রাজা হরি সিংহকে নিজেদের দিকে টানতে না পেরে ১৯৪৭-এর আগ্রাসন থেকে শুরু করে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে লালন করা, অস্ত্র আর টাকাকড়ি জোগানো— কাশ্মীর দখলের লক্ষ্য থেকে পাকিস্তান কখনও সরে আসেনি।

কিন্তু তাতে কি সবটা বলা হল? ব্যাখ্যা করা গেল, ৮ জুলাই বুরহান ওয়ানি নামে এক হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডারের মৃত্যুতে কেন জ্বলে উঠল গোটা উপত্যকা? নজিরবিহীন দাবানল ছড়িয়ে পড়ল শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে? সবটাই প্ররোচনা? ইসলামের নামে জিগির তুলে সকলেই জিহাদে শামিল হয়ে গিয়েছে? না কি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতারা হাতে দুশো-পাঁচশো করে গুঁজে দিচ্ছেন বলেই পেলেটে অন্ধ হয়ে যাওয়ার, বুলেটে মরার ঝুঁকি নিয়ে ছেলেমেয়েগুলো পাথর হাতে নেমে যাচ্ছে পথে?

এ প্রশ্নের ফয়সালা না হলে ‘কথা’ শুরু হতে পারে না। শুধু পাকিস্তানের হাতে গড়া জঙ্গিরা নয়, উচ্চশিক্ষিত ঝকঝকে ছেলেমেয়েরাও কেন ভারতের কথা উঠলে ভুরু কুঁচকে ফেলছেন, তার উত্তর পাওয়া দরকার। সিংহভাগ কাশ্মীরি কেন ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ (যেখানে মুসলিমের সংখ্যা পাকিস্তানের প্রায় সমান) হিসেবে দেখছেন, তারও উত্তর পাওয়া জরুরি।

উত্তর লুকিয়ে আছে একটি শব্দে। ‘আজাদি’। যা শুনলে শুধু এ দেশের নেতারা নন, আমজনতাও কানে আঙুল দেয়। কিন্তু কথা বলতে চাইলে আগে শুনতে শিখতে হবে! হিন্দু রাজার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে গরিব মুসলিম প্রজাকুল তিরিশের দশক থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যে এখনও পূরণ হয়নি। মুসলিম আর হিন্দুর সংখ্যা মেপে যখন ভারত ভাগ হচ্ছে, এঁদের একটা অংশ হয়তো কাশ্মীরের পাকিস্তানভুক্তিই স্বাভাবিক বলে মনে করছিলেন। অন্য এক অংশ আবার চাইছিলেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে না গিয়ে বরং ‘আজাদি’ অক্ষুণ্ণ রাখা হোক। রাজা হরি সিংহকে যে পরামর্শ দিতে গিয়ে চাকরি খুইয়েছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী, প্রত্নতত্ত্ববিদ রামচন্দ্র কাক।

প্রজাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা যে দিন নেহরুর ভারতে যোগ দেওয়ার চুক্তি করলেন, ঠিক তার পরের দিন, ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর শ্রীনগরে পৌঁছল ভারতীয় সেনা। গেল রাজার আর্জি শুনেই। কেননা ততক্ষণে সীমান্ত পার করে সশস্ত্র আদিবাসী পাখতুনদের ঢুকিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। কথা ছিল, এই আগ্রাসন রুখে অবস্থা আয়ত্তে আনা গেলেই বাড়তি সেনা ফিরে যাবে। গণভোট নিয়ে কাশ্মীরবাসীর কাছে জানতে চাওয়া হবে, তাঁরা কী চান।

তা আর হল কোথায়? বরং দুই দেশের থাবায় দু’টো টুকরো হয়ে গেল ভূস্বর্গ। ‘আজাদ’ আর হল না। সেনা চিরস্থায়ী হল কাশ্মীরে। মেরে-কেটে দেড় কোটি কাশ্মীরির জন্য মোতায়েন ৭০ লক্ষ সেনা, প্রতি কুড়ি জনের জন্য এক জন। সেই সঙ্গে পুলিশ আর তাদের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি), স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। দু’পা অন্তর ব্যারিকেড, বডি সার্চ। খানাতল্লাশির নামে মহল্লা ভাঙচুর, ছেলে-বুড়ো-শিশু না দেখে নির্বিচার মার। গণধর্ষণ। হাঁটু গেড়ে বসিয়ে সমস্বরে ‘জয় হিন্দ’ বলতে বাধ্য করা। ‘আফস্পা’র রক্ষাকবচ পরে যখন-তখন তুলে নিয়ে যাওয়া, যাঁদের অনেকেই আর ফিরবে‌ন না, ছবি নিয়ে পরিজনেরা মাথা খুঁড়বেন ক্যাম্পে-ক্যাম্পে, স্ত্রীরা চিহ্নিত হয়ে যাবেন ‘হাফ উইডো’ নামে, যেহেতু তাঁদের স্বামীরা জীবিত না মৃত, তা অজানা।

এর উপরে আছে ‘ইখওয়ানি’রা। নানা জঙ্গি সংগঠন ছেড়ে চলে আসা, ধরা পড়া, আত্মসমর্পণ করা যুবকদের নিয়ে গ়ড়া এই অবৈধ মিলিশিয়ার কাজ পাল্টা নাশকতা চালানো। যেমন ছত্তীসগঢ়ে নকশালদের পাল্টা মার দিতে গড়া হয়েছিল ‘সালওয়া জুড়ুম’। সেনাই তাদের খাওয়ায়-দাওয়ায়, হাতে তুলে দেয় মারণাস্ত্র। প্রয়োজনে ঝেড়েও ফেলে। কিন্তু তারা যে কখন কাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেবে আর জঙ্গির ভেক ধরে কোতল করবে কাকে, কেউ জানে না।

এর পরেও যারা ভাবছি, সেনা আর জঙ্গির মাঝে পড়ে সাধারণ কাশ্মীরিরা হাঁসফাঁস করছেন, ভুল ভাবছি। আমজনতাই এই উত্থানের চালিকাশক্তি। এটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যাই নয়, স্বাধিকারের প্রশ্ন। সেই আজাদির স্বপ্ন, যা দীর্ঘ দিন ধরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে কাশ্মীরি মনের গভীরে। মিশে রয়েছে দীর্ঘ দাসত্বের স্মৃতিতে, রক্তাক্ত হয়েছে রাষ্ট্রচালক তথা নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতায়, যে বিশ্বাসঘাতের কথা আজও তাঁরা বলেন বার বার। কয়েক শতাব্দীর বিষাদ ছেয়ে রয়েছে তাঁদের। দীর্ঘদিন দিল্লিতে লেখাপড়া-সাংবাদিকতা করা বসরত পিরের ‘কারফিউড নাইট’ আখ্যানের পরতে-পরতে জড়িয়ে যে বিষণ্ণতা। যে যন্ত্রণা দিল্লি ছেড়ে শ্রীনগরে ফেরা সাংবাদিক পারভেজ বুখারির কথায়। সীতারাম ইয়েচুরিরা যে দিন গিলানির দরজার সামনে থেকে ফিরে আসছেন, সেই দিনই কলকাতায় পিপলস ফিল্ম কালেকটিভের এক আলোচনায় পারভেজ বলছেন, ‘‘বন্দুক উঁচিয়ে প্রেমের কথা কি চলে? কে বন্ধুর মতো জানতে চেয়েছে, কাশ্মীরিরা কী চান!’’

এক দ‌ল লোক আছেন, এই পর্যন্ত শুনেই যাঁরা হইহই করে উঠবেন— কাশ্মীরি মুসলিমদের মুখে এ সব কথা মানায় না। জানিয়ে দেবেন, পাকপন্থী হুরিয়ত নেতা আর পাক-পোষিত মুজাহিদিনরা কী ভাবে ‘ধর্মযুদ্ধ’ নামিয়ে এনেছেন ভূস্বর্গে। মনে করিয়ে দেবেন, কতটা আতঙ্কে কাশ্মীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন দেড়-দু’লাখ হিন্দু পণ্ডিত।

মুশকিল হল, চিন্তার এই চেনা ছক ছেড়ে বেরোতে না পারলে কথাই আর এগোয় না। উল্টে গোটা আলোচনা একটা অলীক ধর্মযুদ্ধের ধারণার চারপাশে পাক খেতে থাকে। অলীক, কেননা ১৯৮৯-তে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের হয়ে যে ছেলেরা প্রথম হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, তারা ঘোষিত ভাবেই ছিল ‘সেকুলার’। ’৮৭-র ভোটে তুমুল রিগিংয়ে জম্মু-কাশ্মীরের ভোট প্রহসনে পরিণত হওয়ার পরে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই তারা দলে-দলে লাইন অব কন্ট্রোল টপকে ও পারে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল জঙ্গি প্রশিক্ষণ আর বন্দুক নিয়ে। হিজবুল বা লস্কর-এ-তইবার মতো ইসলামি মিলিশিয়া তৈরি করে বছর দু’তিনেকের মধ্যে পাকিস্তান এই আজাদির লড়াই হাইজ্যাক করে নেয়। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে আজাদিপন্থীদের হয় খুন করে, নয় খাঁচায় পোরে। দীর্ঘলালিত আজাদির স্বপ্নকে মুড়ে দেয় ইসলামের চামড়ায়।

প্রতিক্রিয়ায় আমরা, ‘সেকুলার’ ভারত, কী করেছি? কাশ্মীরিদের একটা বিরাট অংশ যে এই মুহূর্তে ভারতীয় সেনাকে ‘হিন্দু ফৌজ’ বলে দেখছেন, তার দায় কি কেবল তাঁদের ধর্মীয় আনুগত্যের? না কি পাকিস্তানের?

ভূস্বর্গে মোতায়েন ভারতীয় সেনায় মুসলিমেরা আছেন, বেশ উঁচু পদেও আছেন কয়েক জন। পুলিশ-প্রশাসনে প্রায় সকলেই স্থানীয় মুসলিম। তাঁরা রাষ্ট্রের অনুগত, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণে হয়তো বা আমাদের চেয়েও বেশি আগ্রহী, আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম। কিন্তু হিন্দু প্রভুত্বের চিহ্ন কি আমরা মুছে ফেলেছি? চেয়েছি মুছতে? না ইসলামি পড়শির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বেছে-বেছে পৌরাণিক বা হিন্দু-গন্ধী নাম তুলে এনেছি আয়ুধ হিসেবে? ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ‘প্রদ্যুম্ন’ বা ‘অগ্নি’, ট্যাঙ্কের নাম ‘অর্জুন’, অ্যাসল্ট রাইফেল ‘কালান্তক’, কার্বাইনের নাম ‘অমোঘ’। উপত্যকা জুড়ে দু’পা অন্তর ক্যাম্পের গায়ে মন্দির। কালীর ছবি।

এবং অমরনাথ যাত্রা নিয়ে বাড়াবাড়ি। তীর্থযাত্রার অধিকার ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের অবশ্যই আছে, সে বালুচিস্তানে হিংলাজ হোক বা কাশ্মীরে অমরনাথ। কিন্তু কত হিন্দু নিরাপদে অমরনাথ ঘুরে এলেন তা যদি কাশ্মীর কতটা ভারতের অঙ্গীভূত হয়েছে সেটা প্রমাণের স্কোরকার্ড হয়ে ওঠে, তা বিপজ্জনক। নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত বন্ধ থাকার পরে যে ভাবে অতিরিক্ত চাঙ্গা করে তোলা হয়েছে অমরনাথ যাত্রাকে, এক এক বছর ছ’লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে যাত্রীর সংখ্যা (অশান্তির জেরে এ বার কম), গোটা তল্লাট ঘিরে ফেলে ভিআইপি মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তীর্থযাত্রীদের, তাঁদের একাংশের, ‘হর হর মহাদেও’ রবে আস্ফালনরত গেরুয়াবাহিনীর যা মৌখিক ও শরীরী ভাষা, তাতে যদি মুসলিম ভূমিপুত্রেরা আহত হন, দোষ দেওয়া যায় কি?

পহেলগাম থেকে অমরনাথ যাত্রা শুরু হয় জুলাইয়ের গোড়ায়। জুনের শেষাশেষি এক বিকেলে গোটা তল্লাট স্কুলের কচিকাঁচাদের ভিড়ে ছয়লাপ। সঙ্গে দিদিমণিরা। ব্যাপার কী? ‘‘পরের সপ্তাহ থেকে তো যাত্রা শুরু। গোটা তল্লাট ঘিরে ফেলবে সেনা। এলাকার মানুষ আর ঢুকতে পারবেন না অন্তত দেড় মাস। তাই ছেলেমেয়েগুলোকে আগেই একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া।’’ কথাগুলো বলছিলেন সঞ্জয় কাক, যাঁর তথ্যচিত্র ‘জশন-এ-আজাদি’ কাশ্মীরের বেদনা অনেকখানি মেলে ধরেছে দুনিয়ার সামনে। যিনি নিজে এক জন বাস্তুচ্যুত কাশ্মীরি পণ্ডিত, বর্তমানে দিল্লি-নিবাসী। কথা শুরুর আগে এই অঙ্কগুলোও বোধহয় বুঝে নেওয়া দরকার।

এটা ঠিকই যে, আমাদের নেতারা শ্রীনগরে গিয়েছিলেন কথা বলতে। কিন্তু শুনতে যাননি সম্ভবত। তাঁরা ভাল করেই জানতেন, কংগ্রেস এবং তার লেজুড় ন্যাশনাল কনফারেন্স বা বিজেপি বিরোধিতা করে জিতে এসে তাদেরই হাত ধরে ফেলা পিডিপি-কে বিশ্বাস করেন না কাশ্মীরিরা। তবু তাদেরই ডাকা হয় সর্বদল বৈঠকে। আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে বাদ দেওয়া হয় সেই হুরিয়ত নেতাদের, যাঁদের কথায় লাখো মানুষ জড়ো হন। কথা বানচাল হবে, জানা ছিল। শুধু তার দায় হুরিয়তের উপরে চাপিয়ে দিতে নিজেরা না গিয়ে বিরোধী নেতাদের গিলানির বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন রাজনাথ সিংহেরা।

এই কূটনীতি দেখতে-দেখতে ক্লান্ত কাশ্মীর। দীর্ঘ ক্লান্তি পাল্টে যাচ্ছে রাগে। যে কোনও ফুলকিতে দাউদাউ করে আগুন ধরে যাচ্ছে। যার আঁচ টের পাচ্ছেন শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিংহ হাসপাতালের ডাক্তারেরা। পেলেটে অন্ধ চোখ, ঝাঁঝরা তরুণ শরীর দেখতে-দেখতে যখন তাঁরা নিজেরাই কেঁদে ফেলছেন, ক্ষতবিক্ষত ছেলেগুলো বলছে, ছাড়া পেয়েই ফের রাস্তায় নামবে তারা। উগরে দেবে মাথাভর্তি রাগ।

তবু যে আমাদের নেতারা আসলে কথা বলতে চান না, বরং কথা বলার ছলে সময় কাটাতে চান, কারণ তাঁরা জানেন গোড়াতেই কাশ্মীর কী চাইবে। সরকারি স্তরে ‘আজাদি’ শব্দ ব্যবহার করেন না ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতারা। কিন্তু তাঁরা দাবি করেন ‘স্বনির্ধারণ’, অর্থাৎ আমার ভবিষ্যৎ আমাকে বেছে নিতে দাও। সেই দাবি মানলে কাশ্মীর যদি গণভোটের জোরে পাকিস্তানে চলে যেতে চায়? সাধারণ মানুষ রাজনীতি-কূটনীতির সূক্ষ্ম অঙ্ক বোঝে না। তারা জানে, জিহাদে মদত দেওয়া থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জে গলা ফাটানো, পাকিস্তানই দুনিয়ার এক মাত্র দেশ যারা সর্বক্ষণ কাশ্মীরের পাশে আছে।

ভূস্বর্গের অবস্থা হয়েছে সেই মেয়েটার মতো, যাকে ছোট থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অভিভাবকদের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার সাহস তার ছিল না। মতামতের প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু এখন আর সে লোকটার সঙ্গে থাকতে পারছে না। প্রতি মুহূর্তে মনোমালিন্য আর দাবিয়ে রাখা। এখন সে পালিয়ে বাঁচতে চায়। এর পরে সে একা থাকবে নাকি পাঁচিলের পাশ থেকে যে লোভী লোকটা রোজ তাকে ফুসলায়, খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরবে তাকেই, সে তো পরের কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE