Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সদিচ্ছার প্রশ্ন, মতাদর্শের নয়

একটা সিদ্ধান্ত যে সমাজের সর্ব স্তরে প্রায় সমান জনপ্রিয় হতে পারে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চেপে ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রমাণ করে দিলেন।

অমিতাভ সরকার
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

একটা সিদ্ধান্ত যে সমাজের সর্ব স্তরে প্রায় সমান জনপ্রিয় হতে পারে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চেপে ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রমাণ করে দিলেন। দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল, ২০১৭ সরকারের হাতে একটা বড় অস্ত্র হল। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যাতে ন্যায্য মূল্যে যথাযথ পরিষেবা দেয়, এবং তাতে যেন সহমর্মিতা ও যত্নের ঘাটতি না থাকে, তা নিশ্চিত করতে অস্ত্রটি জরুরি।

১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন তৈরি হয়। তার পর সেই আইনে বেশ কিছু সংশোধনও হয়। রাজ্য সরকার এই আইনের মাধ্যমেই বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কাজটা নিঃসন্দেহে জটিল, কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবার বেশ কয়েকটি আলাদা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের উপস্থিতি আছে। প্রত্যেকেই মুনাফা অর্জন করতে চায়। এখানে যেমন কর্পোরেট হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ক্লিনিক বা ল্যাবরেটরির মতো পরিষেবা সংস্থা আছে, তেমনই আছে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা, বিমা সংস্থা। বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকলেই অনৈতিক লেনদেনের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। এবং, সেই লেনদেনের প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকের নৈতিকতার বোধও ক্রমে ভোঁতা হয়ে আসতে থাকে। তাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সুবিধা— ডাক্তারদের তারা টাকা তৈরির মেশিনের যন্ত্রাংশ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবা তাদের কাছে পণ্যমাত্র। সেই পণ্য বেচে কত লাভ হবে, সেটা বহুলাংশে ডাক্তারদের ওপর নির্ভর করে।

চিকিৎসার অস্বাভাবিক খরচের রাশ টানার দিকে নতুন বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বিল বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করেছে। হাসপাতালের খরচ বাড়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা, ওষুধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্রোপচারের জন্য। শুধু টাকার দিক থেকেই নয়, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পরিস্থিতিটি মারাত্মক। নতুন বিলে সরকার এই প্রবণতা কমাতে চেষ্টা করেছে। স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন বা নির্দিষ্ট চিকিৎসাবিধি মেনে চলা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে চিকিৎসার নথি রাখার কথা বলা হয়েছে। এতে কি এই দুর্নীতিগুলি কমবে? ধরা যাক, কেউ হার্ট সার্জারির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিন্তু, তাঁর শারীরিক দুর্বলতার জন্য তাঁকে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট দেওয়ারও প্রয়োজন হল। নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে না হয় অস্ত্রোপচার হবে, কিন্তু সাপ্লিমেন্টের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের মতামতই মেনে চলা ভিন্ন উপায়ান্তর নেই। বহু পরীক্ষানিরীক্ষাকেও স্বাস্থ্যবিধির আওতায় ফেলা মুশকিল। কারণ, এই পরীক্ষাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই করা হয় চিকিৎসার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্তরে, রোগীর অবস্থা যাচাই করে দেখার জন্য। কোন রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্যাকেজ তৈরি করা যায় বটে, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ডাক্তারের মত প্রয়োগের বহু অবকাশ রয়েছে। চিকিৎসার প্যাকেজ কী ভাবে স্থির করা হবে, তাতেও ধোঁয়াশা রয়েছে। সরকারই স্থির করে দেবে, না কি হাসপাতালগুলো করবে?

অভিজ্ঞতা বলছে, এই আইনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হল তার যথাযথ প্রয়োগ এবং আইন মানা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে কড়া নজর রাখা। ২০০৭ সালে কর্নাটক সরকার এই গোত্রের একটি আইন তৈরি করেছিল— কর্নাটক প্রাইভেট মেডিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট। দশ বছরেও আইনটি কার্যকর হতে পারেনি। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বিপুল খরচ থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আইনটি ঠিক ভাবে প্রয়োগ করা যায়নি বলেই। সমস্যা বহুমাত্রিক। আইনটিকে কাজে লাগানোর জন্য যত কর্মীর প্রয়োজন, তার অভাব; প্রযুক্তিগত অদক্ষতা; এবং সর্বোপরি, বাজারের জটিলতা— সব মিলিয়ে এই আইনটিকে কার্যকর করে তোলার কাজটা দুরূহ ছিল। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একশোরও বেশি শয্যা আছে, এমন বেসরকারি হাসপাতালে জেনেরিক ওষুধের দোকান এবং সস্তায় পরীক্ষানিরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেই সস্তার ব্যবস্থার প্রতি চিকিৎসকদের সার্বিক অবজ্ঞা দূর করে, আইনের সে সাধ্য কী!

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রটি সাংবিধানিক ভাবে রাজ্যের আওতায়। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ে তার ওপর। স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ করার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ফলেই আজ কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থাগুলির এই রমরমা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য যদি এই হাসপাতালগুলোর চক্র থেকে বেরোতে চায়, তবে দুটোই রাস্তা রয়েছে— এক, নতুন কড়া আইনের মাধ্যমে এই হাসপাতালগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা; দুই, স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ফের সম্পূর্ণ ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করে তোলার রাজনীতি তৈরি করা। গোটা দুনিয়ায় যে দুটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বহুলপ্রশংসিত, সেই ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এবং কিউবার জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দুটোই সম্পূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত। দুটোই উদাহরণ, সরকারি ব্যবস্থাও কী চমৎকার চলতে পারে। মজার কথা, দুই দেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। রাষ্ট্রব্যবস্থাও।

স্পষ্টতই, মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করাটা সদিচ্ছার প্রশ্ন, মতাদর্শের নয়।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE