Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Goddess Kali

যে উগ্রতায় বিরোধিতার রূপ

পরে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এ ভবানন্দের গলায় শুনি ‘বন্দে মাতরম্’। ভারতমাতার শক্তি রূপে বন্দনা।

অলোক রায়
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস-এ শাক্তধর্মের প্রতি বাঙালির আকর্ষণকে অন্যতম উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর ঘনায়মান অন্ধকারে দুর্গা, কালী এবং তারা যে সব শক্তির আধার, একমাত্র ভরসা— এই বিশ্বাসে বাঙালি বুক বেঁধেছিল। বাঙালির বেদ হয়ে উঠেছিল কালিকাপুরাণ আর কালীই ক্রমে বাঙালির প্রধান উপাস্য হন।

পরে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এ ভবানন্দের গলায় শুনি ‘বন্দে মাতরম্’। ভারতমাতার শক্তি রূপে বন্দনা। ইংরেজ পণ্ডিতরা ভাবলেন, ইংরেজ নিধনে অসুরনাশিনী কালীমাকে আহ্বান। আনন্দমঠ-এ কালী কুশাসনে মা যা হয়েছেন, নিঃস্ব রূপ। তাই ক্রোধে ভয়ঙ্করী। লর্ড রোনাল্ডশে বললেন, বন্দে মাতরম্ হল ‘আ প্যারাবল অব পেট্রিয়টিজ়ম’। অরবিন্দ বললেন, ‘দ্য গসপেল অব ফিয়ারলেস স্ট্রেন্থ অ্যান্ড ফোর্স’। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘স্বদেশী আত্মা’। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন, ‘ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ, দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ’, তখন ভাবতেই পারি, কবি বাঙালির শক্তিসাধনার ধারাতেই আপ্লুত। তিনি লেখেন, ‘তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে...’— তাতে মুক্তকেশী কালীর মুখই চোখে ভাসে।

তবু শক্তির কালী রূপ যেন ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্ম পরিবেশে গ্রহণযোগ্য নয়। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, নিবেদিতার সাধনায় দুর্গা, কালী, তারা, চণ্ডীর যে অভেদ অনুভব, রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মমন যেন বুঝেও ঠিক ধরতে পারে না বাঙালির ঘোর কালীপ্রেম। বাল্মীকি প্রতিভা অভিনয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ যখন বাল্মীকি, তখন পাষাণী ডাকাত কালীকে ত্যাগ করে যাওয়ার গান ও অভিব্যক্তি রবীন্দ্রমানসে যেন অস্বাভাবিক। তারাপীঠ, কঙ্কালীতলা দুই সতীপীঠ শান্তিনিকেতনের আশপাশে। প্রান্তিক কৌম সমাজে কালী, শিব কেন জনপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের অজানা নয়। তিনি নিজেও আজীবন জনজাতীয় সমাজের উন্নয়নে নিয়োজিত। তবু বিসর্জন নাটকে বা রাজর্ষি উপন্যাসে দেবী যেন রক্তলোলুপ।

নিবেদিতার কাছে কবি বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ এবং কালী পূজা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। গরিষ্ঠ হিন্দুর সাকার ভক্তিসাধনাকে অস্বীকার করেছিলেন রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, দয়ানন্দ সরস্বতী। পৌত্তলিকতা তাঁদের কাছে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার। শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সেই সাকার সাধনাকে মিলিয়ে দিলেন অদ্বৈতবাদের সঙ্গে। নতুন কিছু নয়। আদি শঙ্করাচার্যের কাছে ব্রহ্ম আর শক্তি অভিন্ন। শক্তি ছাড়া শিব শবমাত্র। কমলাকান্ত, রামপ্রসাদের কালী ভয়ঙ্করী নন, ধরা দেন বাড়ির আদরের মেয়ে হয়ে। বেড়া বাঁধতে বাবার দড়ি ধরেন, শীতবস্ত্র এগিয়ে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ধরা দেন ভক্ত বলরাম বসুর কিশোরী মেয়ে হয়ে। চোখের চাহনিতে জগৎ দোলে। ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা’। তাঁদের সাধনায় সাকার কালী-ই যে ব্রাহ্মদের নিরাকার ব্রহ্ম, সেই বোধ স্পষ্ট। যেন ঋগ্বেদ-এর ‘এক সত্য বহু ভাবে প্রতিভাত’।

নবজাগরণের দিনে বিজ্ঞানমনস্ক কেউ কেউ কালীকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন ‘জনজাতীয়’। এখনও কেউ সে কথা লিখে আধুনিকতা বোঝান। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ লগ্নেও বিশ্বাস করতে পারেন না, অবহেলিত সমাজের আত্মপরিচয়ের মর্যাদা। আমরাও ভুলে যাই, একান্ন সতীপীঠের অনেক স্থানেই তিনি পূজিতা কালীরূপে। আদিশক্তি তাঁর দেহাংশ দিয়ে রক্ষা করেন অখণ্ড ভারতের অঙ্গীকার।

নিবেদিতা ভেবেছিলেন বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন আর ঠাকুরবাড়ির সুসম্পর্ক দেশের সমাজের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু কালীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর ঠাকুরবাড়ির উগ্র বিরোধিতা, উন্নাসিক কথাবার্তায় নিবেদিতার মোহভঙ্গ হয়। কালীঘাট মন্দিরে কালী বিষয়ে সুন্দর ভাবনার উপস্থাপনা করেন নিবেদিতা। সে ভাবনা তাঁর গুরুর কালী সাধনারই প্রকাশ। যথারীতি ব্রাহ্মকুল খুব বিরক্ত কালীবন্দনায়। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী যেন খড়্গ দিয়ে নরেনকে সংসারমায়া মুক্ত করেছিলেন। বিবেকানন্দের জীবনই কালীসাধনা। দুঃখ আর মৃত্যুকে জানা। নিবেদিতাকে বলতেন, ‘মৃত্যুর উপাসনা করো মার্গারেট’।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি শ্রীরামকৃষ্ণকে আমন্ত্রণ জানিয়েও তা ফিরিয়ে নেয়। জানতেন বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের শীতলতার প্রাচীর যেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভবতারিণী। ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মধর্মকে নিয়ে সংস্কার চেষ্টা প্রতিহত হয় দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী আর তার পূজারির কাছে। হয়তো ব্রাহ্মসমাজের কাছে এ ছিল পরাজয়।

বাঙালির কাছে কালী মা। আবার মেয়েও। আদরের, তুইতোকারির সম্পর্ক। কৌম কৃষিসমাজ থেকে পাওয়া, বাঙালির এ বড় নিজস্ব সংস্কার। সে রূপসাগরে খোঁজে অরূপরতন, ইন্দ্রিয়সাধনায় ইন্দ্রিয়াতীতকে। ব্রাহ্মসমাজের অনুভবময় নিরাকার ব্রহ্মভাবনা তাকে তত টানে না। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিমায় অবিশ্বাসী। তবে রবীন্দ্রনাথ সে অর্থে খাঁটি ব্রাহ্ম নন। সে কথা নিজেও বলেছেন। ভানুসিংহের রাধাভাবনা পিছু ছাড়েনি আজীবন। তবু কালী রূপের মাধুরী কোথায় যেন আটকে যায়। ব্রাহ্মসংস্কার যেন জড়িয়ে ধরে বাঙালির প্রাণপুরুষকে। হয়তো বিবেকানন্দের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের অদৃশ্য সংঘাতও। জটাধারী ভৈরব, গোপালক কৃষ্ণ হয়তো পুরুষ বলে গ্রহণযোগ্য। সাহিত্যে আসেন লক্ষ্মী-দুর্গা-সরস্বতীও। কিন্তু কালীর প্রতিষ্ঠানবিরোধী আপাত-উগ্র রূপ যেন কাম্য নয় রবীন্দ্রমননে। রবীন্দ্রনাথ রামপ্রসাদের সুরকে বলেছিলেন বাঙালির প্রাণের সুর, কিন্তু বাঙালির প্রাণেশ্বরী কালীর মাধুরী অধরা কবির ভাবনায়।

প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Goddess Kali Bengali Vedas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE