Advertisement
১৬ মে ২০২৪
Poems. Social Media

এখন কি কবিতা লেখা উচিত

অউশভিৎজ়-এর বীভৎসতার সঙ্গে কোভিড-আক্রমণের তুলনা টানা উচিত নয়।

অংশুমান কর
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২০ ০১:৫৩
Share: Save:

এত কবিতা লেখা হচ্ছে কেন এখন? কেনই বা এত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ফেসবুকে? পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুমিছিল, সেখানে শোক জ্ঞাপনের পরিবর্তে এই ‘ভার্চুয়াল কবিতা কার্নিভাল’ কি অশ্লীল ঠেকছে না? পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বা ট্রেনের তলায় মৃত্যুর কোলে যখন ঢলে পড়ছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, তখন কবিতা নিয়ে কেন এই উন্মাদনা? কবিতা কি পারে করোনা-মুক্ত পৃথিবী গড়তে, অন্ত আনতে পারে এই মৃত্যুমিছিলের? অভিযোগ উঠেছে, কবিতা এখন এলিটদের বিলাস! কবিতাজগৎ থেকে দূরে থাকা মানুষই নন, এমনটা বলছেন কবিদেরও কেউ কেউ। মনে পড়ে যায় থিয়োডোর অ্যাডোর্নোর উক্তি, অউশভিৎজ়-এর পরে কবিতা লেখা অসম্ভব!

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, অউশভিৎজ়-এর বীভৎসতার সঙ্গে কোভিড-আক্রমণের তুলনা টানা উচিত নয়। অউশভিৎজ়-এর নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিল মানুষের প্রতি মানুষের নির্মমতম আচরণের চূড়ান্ত প্রকাশ। আর এখানে মানুষকে লড়তে হচ্ছে মহাশক্তিশালী ভাইরাসের বিরুদ্ধে! পাল্টা যুক্তিও খাড়া করা যায়। আজ অবধি বিশ্বে করোনা-গ্রাসে এই যে তিন লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছেন, এঁরা কি কেউ রাষ্ট্রব্যবস্থার গাফিলতির শিকার হননি? আমাদের দেশেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিহীন লকডাউনের ফলে করোনার অপ্রত্যক্ষ শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ, লকডাউনের নির্মম আঘাত নেমে এসেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপরেই। কার্য-কারণে, নৃশংসতায় তুলনীয় না হতে পারে, মৃত্যুমিছিলে কোথাও কি একটা সংযোগ নেই এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে? আর এই দুই, বা আরও অনেক কারণে, পৃথিবী জুড়ে মানুষের এত মৃত্যুর প্রেক্ষিতে, কবিতা লেখা কি অলীক রঙ্গ নয়?

কবিতা নিয়ে মাতামাতি কেবল ব্যক্তিগত স্তরেই হচ্ছে না। বিশ্ব জুড়ে নানা সংস্থাও এই সময়ে আয়োজন করেছেন ভার্চুয়াল কবিতা উৎসবের। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে ছড়িয়ে অজস্র উদাহরণ। সরকারি সংস্থাগুলিও আয়োজনে পিছিয়ে নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাপ ‘মাইগভ করোনা হাব’ এই রকম উদ্যোগ করেছে। শিল্পীরা সঙ্গীত-নৃত্য পরিবেশন করছেন, কবিরা কবিতা পড়ছেন। একই রকমের উদ্যোগ করেছে সাহিত্য অকাদেমি, আকাশবাণী মৈত্রী চ্যানেল, টিভিতেও কবিতাপাঠ করেছেন শিল্পীরা। এই সব উদ্যোগ কি সত্যিই ‘এলিট’দের দ্বারা, ‘এলিট’দের জন্য গৃহীত?

লিখিত সাহিত্য হিসেবে কবিতার বয়স নেহাতই কম। এও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য, লিখিত মাধ্যমে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক-সংখ্যার বিচারে, মুষ্টিমেয় কিছু জনের ভোগ্য হয়ে ওঠে কবিতা। সে দিক থেকে তাঁরা ‘এলিট’। চিরকালই এ কথা সত্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরে রচিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-কে যদি আধুনিক কবিতার স্বাদ-আস্বাদনে অপারগ এক শ্রমিকের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তিনি তার মর্মবস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হন, তা হলে সেই শ্রমিক বা এলিয়ট— কারও সম্মানহানি হয় না। একটি সময়ের পর থেকে লিখিত কবিতার ভোক্তা যাঁরা, তাঁরা এক দিক থেকে ‘এলিট’ই। কিন্তু এই ‘এলিটিজ়ম’ সব সময় সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির বিচারে নির্ধারিত হয় না। বরং অনেক সময়ে উল্টোটাই সত্য। আজ দেশ জুড়ে যাঁরা কবিতা লিখছেন, পড়ছেন, শুনছেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাঁরা সামাজিক ভাবে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত। সকলে না হলেও এঁদের অনেকেই ‘নিরাপদে’ আছেন, হয়তো খাদ্যচিন্তা করতে হচ্ছে না। আবার, এঁদের অনেকেই জানেন না ভবিষ্যতে চাকরি থাকবে কি না, বা মাইনে কমে যাবে কি না। করোনার গ্রাসে কারও কারও স্বজনবিয়োগও হচ্ছে। এঁরা যদি কবিতার কাছে একটু শুশ্রূষা চান, তা কি অপরাধ? যাঁরা এই শুশ্রূষা পৌঁছে দিতে চাইছেন, তাঁরাও কি অপরাধী? এই অন্তরিন অবস্থায় বাড়িতে বসে নিত্যনতুন খাবারের ছবি পোস্ট করা আর ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করা বা পড়া কি এক? কবিতা নিশ্চয়ই করোনার প্রতিষেধক নয়, কিন্তু সে ক্ষতের মলম হতে পারে। শিল্পের একটি কাজ কি মানব-মনের শুশ্রূষা নয়?

১৯৪৯ সালে তাঁর ‘কালচারাল ক্রিটিসিজ়ম অ্যান্ড সোসাইটি’ প্রবন্ধে অ্যাডোর্নো যা বলেছিলেন, তা নিয়ে সাহিত্যজগৎ তোলপাড় হয়েছে। অনেকে বলেছেন, অ্যাডোর্নো বলেছিলেন, অউশভিৎজ়-এর পর কবিতা লেখা বর্বরতা। অনেকে বলেছেন, তা নয়, উনি বলেছিলেন, অউশভিৎজ়-এর পর মধুর গীতিকবিতা লেখা অসম্ভব। অ্যাডোর্নো ১৯৬২ সালে লেখা ‘কমিটমেন্ট’ প্রবন্ধে, গীতিকবিতার ব্যাখ্যাটিকেই সমর্থন করেছেন। তার পর এও বলেছেন, ওই বীভৎস কাণ্ডের পরে, মানুষের যন্ত্রণাভোগ কেবল শিল্পেই তার কন্ঠস্বর খুঁজে পেতে পারে। পেতে পারে সান্ত্ব্বনা।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই ক্রান্তিকালে লেখা অনেক কবিতাতেই ধরা থাকছে সময়ের চিৎকার। আর সমাজের দর্পণ হিসেবে সাহিত্যের ‘সময়’ নথিভুক্তকরণের যে দায় থাকে, এই সময়ে লিখিত কবিতা সেই দায় পালন করছে—এই বৃহৎ দাবি যদি না-ও তোলা হয়, তবুও এই মুহূর্তে লেখা কবিতাকে বাতিল করা যাবে না। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে এক বাঙালি কবির শরণাপন্ন হই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রায়ই বলতেন, কবিতার কাজ মূলত তিনটি: আনন্দে সমর্থন, সংগ্রামে সাহস আর শোকে সান্ত্বনা দেওয়া। এই কঠিন সময়ে, যদি কবিতা (এমনকি তা গীতিকবিতা হলেও) কিছু মানুষের কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রাখতে পারে, দিতে পারে সাহস আর সান্ত্বনা— তা হলে তা নিয়ে আপত্তি কিসের?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poems Social Media Poetry Auschwitz COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE