Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

রেল ও লাইন

কেবল কর্তৃপক্ষকে দুষিয়া লাভ নাই, ভারতীয় সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দায়বদ্ধতা বস্তুটির অভাব প্রকট।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
Share: Save:

ভুল করিয়া ধরা পড়িলেও অর্ধেকেই ভুল স্বীকার করে না। পার্শ্ববর্তী লোকের দোষ দেয়, বলে চক্রান্ত করিয়া কেহ তাহাকে ফাঁসাইয়াছে, বা সমাজব্যবস্থার দায় স্মরণ করাইয়া তত্ত্বগত ভ্রূ কুঁচকাইয়া থাকে। ধরা না পড়িলে তো স্বীকারোক্তির প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু জাপানে গত সপ্তাহে একটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের কুড়ি সেকেন্ড পূর্বে ছাড়িয়া গিয়াছে বলিয়া, সেই রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা প্রভূত ক্ষমাপ্রার্থনা করিল। এই কুড়ি সেকেন্ডে অন্য কেহই ট্রেনে উঠিতে চাহেন নাই, কেহ নালিশও জানান নাই, তথাপি এই দোষ স্বীকার। শুনিয়া ভারতীয় মানুষের দীর্ঘশ্বাস বাধ্যতামূলক। ভারতে প্রত্যহ অধিকাংশ কাজে ফাঁকিবাজি অসততা দুর্নীতিকে নিয়ম বলিয়া অনেকেই ধরিয়া লইয়াছেন, ট্রেন সময়ে চলিলে বরং বিস্ময়ের কারণ ঘটে। বহু বাস স্টপে দাঁড়ায় না, বহু অটো রুট ভাঙিয়া দেয়, বহু ট্যাক্সি প্রত্যাখ্যানের জন্য উদ্‌গ্রীব হইয়া থাকে, দূরপাল্লার দামি রেলে পচা খাবার পরিবেশিত হয় ও কেহ অভিযোগ গ্রহণ করে না। কেবল যানবাহন নহে, এই কাহন অন্যত্রও প্রযোজ্য। বহু সরকারি ক্ষেত্রে যেন নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে: যথাযথ পরিষেবা দেওয়া হইবে না, তাহার পর বঞ্চিত ভোক্তার সহিত দুর্ব্যবহার করা হইবে। ডেঙ্গি হইলে মানুষকে বাঁচাইবার প্রাণপণ চেষ্টা হইবে না, বরং বলা হইবে, উহা ডেঙ্গি নহে। কিছু মানুষ নিশ্চয়ই এই মনোভঙ্গি বদলাইতে সচেষ্ট, প্রশংসনীয় কাজও করিতেছেন, কিন্তু সাধারণ চিত্র হইল: কর্তৃপক্ষের কর্তব্য নিজের কাজটি করা নহে, চোখ রাঙাইয়া বা অজুহাত দিয়া নিজের অকাজ আড়াল করা।

কেবল কর্তৃপক্ষকে দুষিয়া লাভ নাই, ভারতীয় সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দায়বদ্ধতা বস্তুটির অভাব প্রকট। ব্যতিক্রম অবশ্যই রহিয়াছে, কিছু মানুষ মর্যাদার সহিত দায়িত্ব পালন করিতেছেন, কিন্তু অধিকাংশ নাগরিকের জপমন্ত্র: জঞ্জাল ফেলিবার সময় প্রতিবেশীর দুর্দশার কথা ভাবিব না, লাইনে অন্যকে ঠেলিয়া আগাইয়া যাইব, যত্রতত্র নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিব, ঘুষ দিতে অস্বীকার করিব না, যেখানে পারিব অন্যায় সুবিধা লইব, অফিসে ফাইল সরাইয়া আড্ডায় মাতিব। জাপানে সিংহভাগ মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রখর, নিয়মানুবর্তিতা পরিচ্ছন্নতা নম্রতার অভ্যাস পালন করিতে তাঁহারা তৎপর, অন্যের অসুবিধার কারণ না ঘটাইবার জন্য নিজের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখিবার ঐতিহ্য রহিয়াছে। ওই সমাজে এমন রেলগাড়ির জন্ম হইবে, আশ্চর্য কী। কিন্তু সকল রূপকথার ন্যায়, এই কাহিনিরও কিছু নেতিবাচক পাঠ বর্তমান। ২০০৫ সালে জাপানে এক চালক ৯০ সেকেন্ডের বিলম্ব মিটাইতে গিয়া অতিরিক্ত দ্রুত গতিতে রেল চালাইবার ফলে শতাধিক যাত্রী প্রাণ হারাইয়াছিলেন। শৃঙ্খলা ও উৎকর্ষের প্রতি অতিমানবিক মনোযোগের কারণে বহু সময় বিপরীত ফলও হইতে পারে, কারণ প্রতিটি মুহূর্তে ছকবন্দি নিখুঁত কাজ করিতে গিয়া, সকল অনুুপুঙ্খ অভ্রান্ত ভাবে পালনের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করিতে গিয়া, প্রণালীটি কখনও লক্ষ্যের অপেক্ষা বৃহৎ হইয়া দেখা দিতে পারে। তখন ছোট একটি ত্রুটির প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকিয়া পড়িবার ফলে বৃহৎ ব্যাপারটির সর্বনাশ সাধনও সম্ভব। অন্তত তাহা ভাবিয়া ভারত কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাইতে পারে, কারণ নিয়ম মানিতে রেলগাড়ি ব্যস্ত হইবে, এমন লাইন-বাঁধা ধারণা এই দেশে গজাইবার আশু সম্ভাবনা নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian society responsibility Indian Railways
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE