অক্সফোর্ড অভিধান কর্তৃপক্ষ বিস্তর হিসেব করে জানিয়েছেন ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ: টক্সিক! ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ছিল ‘পোস্ট ট্রুথ’। আমরা ভারতীয়, আমাদের এমন গুনেগেঁথে হিসেব কষার রেওয়াজ নেই। প্রয়োজনও নেই। গত পাঁচ বছরে ফেক খবর, ছবি, পোস্ট ট্রুথ, ইতিহাস বিকৃতি, একের পর এক সিঁড়ি পেরিয়ে আজকের এই টক্সিক বা বিষাক্ত পরিমণ্ডলে পৌঁছেছি। ধর্মের ভিত্তিতে, জাতির ভিত্তিতে, প্রাদেশিকতার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিদ্বেষের বিষ সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজের একটা বড় অংশে।
মানছি, নোটবন্দি কাণ্ডের কুফল যেখানে পৌঁছেছিল, তার তুলনা বিরল। বহু লোকের মৃত্যু, কাজ হারানো ছাড়াও দেশের অর্থনীতিকেও এক ধাক্কায় পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে কয়েক বছর। মানছি, শিল্পপতিদের ৩.১৬ লাখ কোটি ঋণ তামাদি হয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর নাভিশ্বাস, রাফাল, আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি ইত্যাদি অপদার্থতা ও আর্থিক অনিয়মের গুরুত্বও বিস্তর। তবু বলব, এই আর্থিক দুর্নীতি ও ক্ষতিগুলো শরীরের বাইরের কাটাছেঁড়ার মতো। এর চিকিৎসা করা সম্ভব। আশা করা যায়, দ্রুত এ ক্ষত সারবে। কিন্তু মানুষে মানুষে এই ঘৃণা, এই বিদ্বেষের বিষ, এ অসুখ ভারতাত্মার ভেতরে বাসা বাঁধলে রেহাই পাওয়া খুব মুশকিল। বিভেদভাবনা বার বার প্রকট হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। যে ভারতবর্ষে নজরুল শ্যামাসঙ্গীত লেখেন, বিয়েবাড়িতে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ আর বিসমিল্লার সানাই চলে একই সঙ্গে, চারশো ছত্রিশ বছর আগে যে দেশের বাদশাহ নানা ধর্মের সমম্বয়ে প্রবর্তন করেছিলেন নতুন ধর্মমত দীন ই ইলাহির, যে দেশে আজও বিশ্বাস করা হয় ভক্ত জালালের জন্য স্বয়ং জগন্নাথদেবের ইচ্ছায় থমকে গিয়েছিল পুরীর রথ, যে দেশের অবিসংবাদী নেতা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে হরিজন সাফাইওয়ালাদের বস্তিতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন, সে দেশে আজ বহুত্ববাদ ও পরমতসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য বিপন্ন।
কেউ কেউ বলেন, এর আগে কি ভারতে কখনও বিভেদ বিদ্বেষ দেখা যায়নি? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি? তাঁদের বলব, তখন আর এখন রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং সক্রিয়তা তুলনা করে দেখুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তফাতটা কোথায়। আগে বিভেদবাদী বা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সেই নামেই ডাকা হত। রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের মোকাবিলার চেষ্টা হত, এ ভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হত না। কিছু সাধারণ মানুষের ইতিহাসবিমুখতা, তলিয়ে ভেবে দেখার অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, মিথ্যা খবর আর বিকৃত ইতিহাস প্রচার করে, এই সব অপশক্তির অপকর্মকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হত না। আর আজ? কখনও সাম্রাজ্যবিস্তার আর রাজ্যরক্ষার ঐতিহাসিক যুদ্ধকে হিন্দু-মুসলমান লড়াই বলে চালানো হচ্ছে, কখনও বা সরকারি সংস্থার আইডি ব্যবহার করে উইকিপিডিয়ায় পাল্টে দেওয়া হচ্ছে নেহরুর বংশলতিকা (যদিও উইকিপিডিয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভুল সংশোধন করে নিয়েছিল)। আর এই কাজগুলো কিছু দলীয় কর্মী সংগঠিত ভাবে করছেন বলে অভিযোগ।
আর্থিক দুর্নীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবু তার প্রতিকারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো আছে। আজ না হলে কাল বিচারের সুযোগ আছে। কিন্তু দেশ জুড়ে এই অবিশ্বাস বা ঘৃণার দূষণকে আটকাতে পারে একমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনতা। আমাদেরই একটু তলিয়ে ভেবে দেখতে হবে, কেন কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে এত অনীহা? কেন উল্টে প্রশ্নকারীকে পাল্টা আক্রমণ? কেন সাড়ে চার বছরে সর্বোচ্চ নেতার একটাও সাংবাদিক সম্মেলন হয় না? কেন সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক থেকে তদন্তকারী সংস্থা, সমস্ত নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার বিপন্ন? কেন তথ্যের অধিকার বিলুপ্তপ্রায়? সেনাধ্যক্ষ কেন রাজনৈতিক বিবৃতি দেবেন?
ক্রমাগত ছাতি চাপড়ে, বা কেঁদে, এককে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে হয়তো ভোটে জেতা যায়, কিন্তু দেশের উন্নতি করা যায় না। আমরা চাইব প্রশাসক যেন এমন হয়, সে তার পুরো মেধা, মনন ও পরিশ্রম ব্যয় করতে পারে দেশের উন্নতিকল্পে। জাতি, প্রদেশ বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভেদ ছড়ানোর নিত্য নতুন পরিকল্পনা করার জন্য নয়। এই বিদ্বেষদীর্ণ ভারত আমাদের কাম্য নয়।২০১৯-এ অভিধানে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দ হোক, সহিষ্ণুতা। না কি, ডিটক্সিফিকেশন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy