Advertisement
০৪ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

নামের জুজু

সলমন রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করিবার ক্ষেত্রেও এই দেশ প্রথম হয়, আর পঞ্জাবের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করিতে পারে ভাবিয়া ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবিতে ৮৯টি কাট করিবার উদ্ভট পরামর্শও এই দেশেরই সেন্সর বোর্ড ভাবিয়া বাহির করে।

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ভারতের রক্ষণশীল ও কিঞ্চিৎ হাস্যকর রকমের রুদ্ধমনা বলিয়া পৃথিবীতে নাম আছে। এই দেশে প্রায় যে কোনও সরকারই সম্ভাব্য অশান্তির ভয়ে কাঁটা হইয়া থাকে, ডাইনে-বামে শিল্পবস্তু নিষিদ্ধ করিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে। সলমন রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করিবার ক্ষেত্রেও এই দেশ প্রথম হয়, আর পঞ্জাবের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করিতে পারে ভাবিয়া ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবিতে ৮৯টি কাট করিবার উদ্ভট পরামর্শও এই দেশেরই সেন্সর বোর্ড ভাবিয়া বাহির করে। কিন্তু এই বারের ভারতীয় আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব হইতে দুইটি ছবিকে বাদ দেওয়া হইল, ভারপ্রাপ্ত জুরি সেইগুলিকে নির্বাচিত করা সত্ত্বেও, সম্ভবত কেবল তাহাদের নামের জন্য: ‘ন্যুড’ ও ‘সেক্সি দুর্গা’। শেষ ছবিটিকে ‘এস দুর্গা’ নাম দিয়া পরিচালক বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু বহু জুরি সদস্যও প্রশ্ন তুলিয়াছেন, বিষয়ে ও ভঙ্গিতে যদি আপত্তিকর কিছু না থাকে, কেবল নামের জন্য ছবি বাদ দিবার ভিত্তি কী? যুগে যুগে ভারতীয় সরকার শিল্পে যৌনতার কট্টর বিরোধী, তাহা স্পষ্ট। এ দেশে খাজুরাহো নির্মিত হইয়াছিল, তাহা বোধহয় কোনও সরকারই বিশ্বাস করে না। কিন্তু যে ছবিটি নির্মাণ করা হইয়াছে চিত্রকরদের মডেল হিসাবে কর্মরতা মহিলাদের লইয়া, তাহার নাম ‘ন্যুড’ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। অন্য ছবিটির সহিতও দেবী দুর্গার কোনও সম্পর্কই নাই, তাহার নায়িকার নাম দুর্গা। তাহা হইলে কি ভারত সরকার চাহিতেছে, কোনও হিন্দু দেবদেবীর নামে কোনও ভারতীয় শিল্পের চরিত্রের নাম রাখা যাইবে না? কারণ কৃষ্ণ নামধারী কোনও নর শৌচকার্যের জন্য কলঘরে যাইতেছেন, বা সীতা নাম্নী কেরানি ঘুষ লইতেছেন— এমন দৃশ্যও তো ছবিতে থাকিতে পারে। শিল্পের নামটিকেও এমন জুজু ঠাওরাইলে, ভারত চলতি চুটকির অঙ্গ হইয়া যাইবে।

এ কথা ঠিক, ভারতে বহু গোষ্ঠী প্রাতে উঠিয়াই সন্ধান শুরু করে, কী ভাবে তাহারা অপমানিত বোধ করিতে পারে ও আন্দোলন শুরু করিতে পারে। কেহ এম এফ হুসেনকে দেশছাড়া করিতে চাহে, কেহ তসলিমা নাসরিনকে। দেশে পরিচিতি-ভিত্তিক রাজনীতির উত্থান এই প্রবণতার এক কারণ। মুশকিল হইল, কোনও গোষ্ঠীকেই কোনও ভাবেই আঘাত করিবে না, সকলকেই তুষ্ট ও অহংপুষ্ট করিয়া চলিবে, এমন শিল্প করিতে গেলে সকল গ্রন্থ বা ক্যামেরাকে যে জীবাণুমুক্তির স্প্রে দিয়া ধুইতে হইবে, তাহা আবিষ্কৃত হয় নাই। সর্বোপরি, তেমন শিল্প করিতে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিল্পীরা আদৌ রাজি হইবেন না। তাঁহারা তো বলিবার জন্য শিল্প করিতেছেন। না-বলিবার জন্য নহে। সরকারের প্রকৃত দায়িত্ব, শিল্পকে কথা বলিতে দেওয়া ও তজ্জনিত অশান্তি হইলে প্রশাসন ব্যবহার করিয়া তাহা রোধ করা। এই সরকার উলটা পথে হাঁটিতেছেন, কেবল দাঙ্গা এড়াইবার দায়ে নহে, এই অজুহাতে শিল্প, প্রশ্ন, তর্ক, ব্যঙ্গ— সকল কিছু দুরমুশ করিয়া একটি অখণ্ডমণ্ডলাকার পিণ্ড বানাইতে পারিবেন বলিয়া। যে পিণ্ডের চোখ নাই নখ নাই, ছোটে না কি হাঁটে না, কাহাকেও যে কাটে না। অবশ্য এই কথা যে পদ্য হইতে লিখা হইল, তাহার নাম ‘বাবুরাম সাপুড়ে’, উহাতে, কে বলিতে পারে, হয়তো রামের অপমান নিহিত আছে, সুকুমারকে প্ল্যানচেট করিয়া নামটি ‘বাবু আর. সাপুড়ে’ করিবার নির্দেশ দান কেবল সময়ের অপেক্ষা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Film Festival Censor Board
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE