ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মানুষের ব্যক্তিপরিসরের স্বাতন্ত্র্যের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দিয়েছেন। রায়ের গোড়ার দিকেই জানানো হয়েছে, ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অধিকার, নাগরিকের একান্ত নিভৃতি অলঙ্ঘনীয়। তবে সেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সমাজজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষ করে প্রযুক্তির দাপটে তথ্যের অন্তর্জালে যখন মানুষ আটকে পড়েছেন, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন তখন তাঁর এই নিভৃতির অধিকার কতটা থাকবে আর কতটা যাবে, তার পুনর্বিবেচনা জরুরি। হক কথা। ব্যক্তির ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর সমূহের খবরদারি, ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের তথ্য জানার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করে। আর ব্যক্তিকে দমিয়ে রেখে সবাইকে এক ছাঁচে ঢালাই করা হল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ও লাভদায়ক প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য। মানবিকতার দিক দিয়ে বিচার করলে এ মস্ত গলদ। এ কথাটা বিশ শতকে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯২৪। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস। রবীন্দ্রনাথ তখন আর্জেন্টিনা সফর করছেন। সঙ্গে এলমহার্স্ট। নানা বিষয়ে কবি কথা বলেন, এলমহার্স্ট তা লিখেও রাখেন। তাঁদের কথা হয় রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘রক্তকরবী’ নিয়ে। এ নাটকের রবীন্দ্রনাথের করা ইংরেজি অনুবাদ ‘রেড অলিয়েন্ডার্স’, অবাঙালি পাঠকদের কাছে নাটকটি একটু জটিলই লেগেছিল। সে জন্য পরের বছর ১৯২৫-এ রবীন্দ্রনাথকে নাটকের একটি ব্যাখ্যাও লিখতে হয়েছিল ইংরেজিতে। লিখলেন তিনি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আধুনিক সময়ে ব্যক্তিমানুষকে (পার্সোনাল ম্যান) নিয়ন্ত্রণ করছে সংগঠিত মানুষ (অর্গানাইজড ম্যান)। এই সংগঠিত ব্যবস্থা কোনও একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। তার দানবীয় ক্ষমতা, অপরিসীম কৌতূহল। সেই কৌতূহলে সে মানুষকে কাটাছেঁড়া করে, জানে। কিন্তু সেই মানুষকে বোঝার ও তার প্রতি সমানুভূতি দেখানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। ‘রক্তকরবী’ নাটকে এক খনিশহরে সাধারণ মানুষের ওপরে নজরদারি ও খবরদারি করত প্রশাসন। মানুষ কী করছে, কী ভাবছে, কী খাচ্ছে, কে কার সঙ্গে কী কথা বলছে, কে কাকে ভালবাসছে, সব বিষয়ে নজর রাখত প্রশাসনের চরেরা। তার পর সোজা ঢুকে পড়ত সেই একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে। আর তা না মানলেই নেমে আসত শাস্তির খাঁড়া। এ ভাবে সবাই পরিণত হত খনিশহরের লাভের শর্তে কাজ করার যন্ত্রে।
১৯৩৬-এ চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ ছবিতেও ছিল একই রকম কথা। বেচারা শ্রমিক চ্যাপলিন কাজের ফাঁকে ওয়াশরুমে ঢুকে সবে আরাম করে একটু সিগারেট ধরিয়েছে, আর যায় কোথায়! কোম্পানি মালিকের দানবীয় নজরদারি- যন্ত্রে ধরা পড়েছে তা। সঙ্গে সঙ্গে বকুনি। চার্লি আলস্য ছেড়ে কোম্পানির লাভের জন্য কাজ করতে বাধ্য। এই কথাগুলিই এলমহার্স্টকে আর এক ভাবে তাঁর আর্জেন্টিনা সফরকালে বলেছিলেন কবি। বলেছিলেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বগ্রাসী লোভের কথা। বস্তুর লোভ, ক্ষমতার লোভ, তথ্যের লোভ। তথ্য জানা খুব জরুরি। কখন চার্লি ফাঁকি দেয়, কখন খনিশহরের শ্রমিকেরা অলস ভাবে মোড়লদের বিরোধিতা করে, সব জানা চাই। একান্ত নিভৃতি, নিরিবিলি, ব্যক্তিগত জীবনযাপন, সবই রাষ্ট্রের, কোম্পানির, সংগঠনের লাভের পরিপন্থী। তাই ওগুলোকে বন্ধ করে দাও, সব স্বরকে এক করে রাষ্ট্রের লাভের জোয়ালে লাগাও।
তা হলে কি রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা যৌথে বিশ্বাসই করতেন না? তবে কি কোনও সংগঠন গড়ে তোলাই যাবে না? উত্তর হল, বিশ্বাস করতেন, সংগঠন গড়ে তোলা যাবে। তবে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র যে ভাবে ওপর থেকে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সে পদ্ধতিতে বিশ্বাস করতেন না রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তিমানুষের জীবনযাপনের ঐকান্তিক অধিকারকে বজায় রেখে কী ভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংগঠন গড়ে তোলা যায় তারই অনুসন্ধান করছিলেন তিনি। সন্দেহ নেই, এটা খুবই বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যক্তির স্বাধিকার এবং সমাজ, রাষ্ট্র সামূহিকতার দায়িত্ব, দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যের কথা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রয়েছে।
১৯৩০। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথ একটি শব্দ ব্যবহার করলেন— ঐকত্রিকতা। ঐকত্রিকতা মানে এক হওয়া। লিখলেন, ‘ঐকত্রিকতার মূলনীতি হচ্ছে সমাজবদ্ধ স্বেচ্ছাকৃত যোগ।’ স্বেচ্ছায় যদি সবাই দলবদ্ধ হয় তা হলে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি নেই। যেমন মহাত্মা গাঁধী যখন অসহযোগ করেন, চরকা কাটেন তখন রবীন্দ্রনাথ সেই নীতিকে সম্মান জানান। কিন্তু অসহযোগের মূলনীতি না বুঝে হুজুগে গাঁধীবাদী হয়ে দল পাকালে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি। একই ভাবে বয়কট আন্দোলনে স্বেচ্ছায় কেউ যোগ দিলে কিছু বলার নেই। কিন্তু দরিদ্র মানুষকে বিলিতি বয়কট করিয়ে বেশি দামে স্বদেশি বস্ত্র কেনালে জুলুম করা হবে। রাশিয়ায় যেখানে মানুষ স্বেচ্ছাব্রতী সেখানে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ, যেখানে ‘ছাঁচ বানিয়েছে’ সেখানে কবির আপত্তি। ‘ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না’— রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী: ‘সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে’।
সর্বোচ্চ আদালত এমন একটা সময়ে ব্যক্তিমানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেন, যখন ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশেষ একটি ছাঁচে নাগরিকদের ঢালাই করতে চাইছে। ভারতের মতো বহুস্বরের দেশের পক্ষে একছাঁচ খুবই ক্ষতিকর। এ দিক থেকে আদালতের এই রায় খুবই জরুরি। ব্যক্তিমানুষের স্বাধিকার ও স্বেচ্ছা বজায় রেখে কী ভাবে দরকার মতো সংঘবদ্ধ হওয়া যায় সেটাই মানুষের সাধনা। কাজটা কঠিন।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy