ভারতে অশান্তি নিয়ন্ত্রণে শাসকের একটি প্রিয় অস্ত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ। যেখানে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হইয়া ওঠে, সেখানেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করিয়া দেয় সরকার। একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ, এই বৎসরের প্রথম সাড়ে ছয় মাসে কুড়ি বার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করিয়াছে রাষ্ট্র। ২০১৬ সালে একত্রিশ বার ইন্টারনেটে নিষেধাজ্ঞা জারি হইয়াছিল। ব্যাঙ্কের কাজ হইতে বাণিজ্য-বিপণন, সকলই এখন অনলাইন। তাই এমন অবরোধে বছরে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা। আর্থিক ক্ষতি অপেক্ষাও বড় প্রশ্ন, নাগরিকের কি তথ্য পাইবার অধিকার নাই? পরস্পরের সহিত সংযোগের অধিকার নাই? ইচ্ছামতো তাহা খণ্ডিত, ব্যাহত করিবার অধিকার কি রাষ্ট্র দাবি করিতে পারে? কত কারণেই না রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করিতেছে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন সামলাইতে, উত্তরপ্রদেশে দলিত-রাজপুত সংঘর্ষ থামাইতে, গুজরাতে টোকাটুকি বন্ধ করিতে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হইয়াছে। কাশ্মীরে গত বৎসর জুলাই হইতে নভেম্বর ইন্টারনেট সংযোগ অবরুদ্ধ হইয়াছিল, এই বৎসরও ইতিমধ্যেই কিছু সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ও অ্যাপ নিষিদ্ধ।
ইন্টারনেট অবরোধ বাক্স্বাধীনতায় আঘাত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যাহা অপরাধ। রাষ্ট্রপুঞ্জও ইন্টারনেটে সংযোগের অধিকারকে বাক্স্বাধীনতার অধিকার ও তথ্যের অধিকারের অন্তর্গত বলিয়া বিবৃতি দিয়াছে। অথচ ভারতে নেতা-আধিকারিকরা বিধিলঙ্ঘনকেই বিধি করিয়া ফেলিয়াছেন। এমনকী সংশোধিত তথ্য ও প্রযুক্তি আইন (২০০৮) অনুসারে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করিবার প্রাক্শর্ত হিসাবে যে সকল পদক্ষেপের বিধি রহিয়াছে, সেগুলিও মানা হয় না। কেন্দ্র বা রাজ্য কখনও ঔপনিবেশিক যুগের টেলিগ্রাফ আইন, কখনও স্রেফ ১৪৪ ধারার বলে ইন্টারনেট অবরুদ্ধ করিতেছে। এই ব্যাধি কার্যত দলনিরপেক্ষ— ইউপিএ এবং এনডিএ-র ভেদ নাই, ভেদ নাই কেন্দ্রে ও রাজ্যে।
সরকারের যুক্তি, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। অশান্তিকামীরা ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যমে আরও সংগঠিত হইতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক নহে। ‘আরব বসন্ত’ হইতে হংকঙে সরকার-বিরোধী প্রতিরোধ, সর্বত্র জন-আন্দোলনগুলি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করিয়া সংগঠিত হইয়াছে। যে কোনও সংযোগমাধ্যমের অপব্যবহার হইতে পারে, ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও তাহাই হইতেছে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ না করিয়া, তাহাকে ব্যবহার করিয়া বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাইতে পারে। গত বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে বেঙ্গালুরুতে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হইলে রাজ্য পুলিশ টুইট ব্যবহার করিয়া নাগরিকদের পরিস্থিতির বিষয়ে যথাযথ খবর জানাইয়া গিয়াছে, প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করিয়াছে। গুজব প্রতিহত করিয়া শান্তি ফিরাইবার ইহা একটি পথ। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করিলে অশান্তি নিয়ন্ত্রণে আসে কি না, তাহাও স্পষ্ট নহে। কাশ্মীরে তেমন আশ্বাস মেলে নাই। দার্জিলিঙে আন্দোলন সামলাইতে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হইল। ইহাতে প্রশাসন কতটা লাভবান হইবে, বাসিন্দারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন, তাহা ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে ‘ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া’ চোট খাইবে, সন্দেহ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy