চৌদ্দ বৎসর বনবাস না হইলেও চৌদ্দ বৎসরের দূরবাস বলাই যায়। আরিয়েল শ্যারন-এর পর এত দিনে আবার এক ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ভারতের মাটিতে পা রাখিলেন। ঢাক-ঢোল পিটাইয়া দ্বিদেশিক মিত্রতা হাঁটুজল হইতে গভীর জলে নামিল। নরেন্দ্র মোদী ও বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু, দুই জনই ঘনিষ্ঠতার এই ‘কৃতিত্ব’ নিজ নিজ দেশে প্রচারিত করিবার সমস্ত রকম প্রয়াস করিলেন। বাস্তবিক, তাঁহাদের দেখিয়া মনে হইতেছিল, সম্পর্কের বন্ধন অপেক্ষা সম্পর্কের প্রদর্শনটি তাঁহাদের দৃষ্টিতে অনেক জরুরি। স্বাভাবিক। গুজরাতে জয় আসিলেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর সুসময় যাইতেছে না। তাঁহাকে নূতন করিয়া নিজের গরিমার প্রমাণ ও প্রচারে মন দিতে হইতেছে। একই ভাবে, নেতানিয়াহু তাঁহার দেশে নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগে হাবুডুবু খাইতেছেন। ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাঁহার কদর ইজরায়েলবাসীকে দেখাইতে তিনিও অত্যন্ত আগ্রহী। ঘরোয়া রাজনীতির চাপে উদ্বুদ্ধ কূটনীতির ফলে ভারতের কপালে জুটিল অনেকগুলি চুক্তি, আর ইজরায়েলের পকেটে আসিল ভারতের বিশালাকার বাজার। নেতৃদ্বয়ের বক্তৃতার মধ্যে যে ধ্বনিত হইল ভারতের ‘আকার ও মাত্রা’র (‘সাইজ’ ও ‘স্কেল’) বিশালতার কথা, আর ইজরায়েলের ‘তীক্ষ্ণ ধারালো’ (‘শার্পনেস’ ও ‘এজ’) প্রকৃতির কথা, তাহা কেবল প্রতীকী নহে, শাব্দিক ব্যঞ্জনার এক ভিন্ন মহিমায় উদ্ভাসিত। সব মিলাইয়া কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক: ত্র্যহস্পর্শে এই সফর দুই দেশের আকাশেই উজ্জ্বল মুহূর্ত।
ভারতের দিক হইতে সামরিক চুক্তিটিই প্রধান, সংশয়ের অবকাশ নাই। গত এপ্রিলে ইজরায়েলের নিকট হইতে ভারতের ২০০ কোটি ডলারের সামরিক সম্ভার কিনিবার সম্ভাবনাটি এই বৎসরের গোড়ায় বানচাল হইতে বসিয়াছিল, যখন ৫ কোটি ডলার মূল্যের অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল প্রযুক্তি আমদানি লইয়া অনিশ্চিতি দেখা দেয়। এই সফর সেই অনিশ্চিতি দূর করিয়া বোঝাপড়াকে বাঁচাইয়া দিয়াছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ চুলায় দিয়া ভারত পুনরায় স্থির করিয়াছে, ইজরায়েলের মিসাইলই কেনা হইবে। অস্ত্র-প্রসঙ্গে ইজরায়েলের উপর ভারতের নির্ভরতা এই বার যে বিন্দুতে পৌঁছাইল, তাহাতে মিত্রতা দীর্ঘজীবী হইবার পথ প্রশস্ত। এক দিকে গুজরাতে সাবরমতী আশ্রমে মহাত্মা-তর্পণ ও অন্য দিকে সামরিক বিনিময়ের মহাপ্রকল্প: দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব যাঁহারা খুঁজিবেন, তাঁহারা সম্পর্কের আসল রসায়নটির হদিশ পাইবেন না। সেই রসায়ন লুকাইয়া আছে ভূ-রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। ইজরায়েল জানে, প্যালেস্টাইন লইয়া ভারতের অবস্থান যাহাই হউক না কেন, বিজেপি-শাসিত দেশটির এখন ইজরায়েলের প্রতি মিত্রতার বার্তা পাঠানো ভিন্ন গত্যন্তর নাই। ইজরায়েলেরও ভারতকে প্রয়োজন, যে কোনও মূল্যে।
বাণিজ্য চুক্তিগুলিকেও কমাইয়া দেখিলে চলিবে না। আগামী তিন বৎসরের মধ্যে ভারতে ২৫ শতাংশ রফতানি বাণিজ্য বাড়াইবে ইজরায়েল, এই লক্ষ্য স্থির করিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে। কাহার বেশি লাভ, সে তর্ক বকেয়া রাখিয়া একটি কথা প্রথমেই স্বীকার করা দরকার। নেতানিয়াহুর আপন নীতি, কূটনীতির বিশ্বে যাহার ডাক নাম এখন নেতানিয়াহুরই ডাকনামে অন্বিত, ‘বিবি ডকট্রিন’— এই সফর তাহার সাফল্যের স্পষ্ট সূচক। কৃষিসেচ প্রযুক্তি হইতে শুরু করিয়া মিসাইল ও সাইবার-নিরাপত্তা, যে কোনও ক্ষেত্রেই এইগুলি তৈরি করা ও রফতানি করা ইজরায়েলের পক্ষে ব্যয়সাপেক্ষ। বাজার শক্তপোক্ত না হইলে সেই ব্যয় করিবার সাধ্য কী। বাজারকে শক্ত করিবার জন্য ইজরায়েলের রফতানি-শক্তি বাড়াইতেই হইবে। উৎসাহী ক্রেতা দেশগুলিকে সে জন্য বাজার উন্মুক্ত করিতে হইবে। ইজরায়েলের সেই বাজার-প্রসারণের ব্যবস্থা করিতে ভারত এখন প্রস্তুত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy