Advertisement
০৪ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

এ ভাবে হয় না

সিস্টেমটা বামেদের গড়া। মমতা তাতে নিজের দখল কায়েম করেছেন। যে সিস্টেম বামেদের ৩৪ বছর দিয়েছে, মমতাকে অন্তত ১০ বছর দেবে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারার কথা ছিল না। মমতা হারেননি।— এই সহজ কথাটা গত কিছু দিন ধরে অনেকেই বুঝতে চাইছিলেন না। বিশেষত তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ। কেন? মমতা তাঁর পাঁচ বছরের শাসনে এমন অজস্র কাজ করেছেন এবং তার চেয়েও বেশি করে এমন অজস্র কথা বলেছেন, যেটা গণতন্ত্রের পক্ষে একেবারেই মঙ্গলজনক নয়। তার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁদের রাগ প্রকাশ করতেই পারেন। করাই উচিত। কিন্তু শুধুমাত্র সেই কারণে পাঁচ বছরের মাথায় মমতা সরকারের পতন ঘটবে, এটা ধরে নেওয়া কিঞ্চিত বাড়াবাড়ি ছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:১৪
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারার কথা ছিল না। মমতা হারেননি।— এই সহজ কথাটা গত কিছু দিন ধরে অনেকেই বুঝতে চাইছিলেন না। বিশেষত তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ। কেন? মমতা তাঁর পাঁচ বছরের শাসনে এমন অজস্র কাজ করেছেন এবং তার চেয়েও বেশি করে এমন অজস্র কথা বলেছেন, যেটা গণতন্ত্রের পক্ষে একেবারেই মঙ্গলজনক নয়। তার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁদের রাগ প্রকাশ করতেই পারেন। করাই উচিত। কিন্তু শুধুমাত্র সেই কারণে পাঁচ বছরের মাথায় মমতা সরকারের পতন ঘটবে, এটা ধরে নেওয়া কিঞ্চিত বাড়াবাড়ি ছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে।

পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলানোর রেওয়াজ নেই। এবং মমতার ক্ষমতায় আসাটা কোনও রুটিন ঘটনা ছিল না। ৩৪ বছর পর মানুষ যখন কোনও দলকে মাটিতে আছড়ে ফেলে, খুব সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা সম্ভব, তার পিছনে দীর্ঘ পুঞ্জীভূত রাগ থাকে। পাঁচ বছরে সে রাগ মিলিয়ে যেতে পারে না। বামফ্রন্ট এই পাঁচ বছরে এমন কোনও নতুন নেতৃত্বও তৈরি করতে পারেনি, যাকে দেখে সেই পুরনো রাগ উস্কে উঠবে না। এবং জোট-পরবর্তী হইচই শুরু হতেই বাম নেতৃত্বের অতি চেনা সবজান্তা ঔদ্ধত্য আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা যে ভাবে ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, তাতে স্মৃতিতে যেটুকু বা ধুলো জমেছিল, নিমেষে উড়ে গেল।

উল্টো দিকে, মমতার সরকার অনেক অকাজের পাশে পাঁচ বছরে অনেক কাজই করেছে, যা সরাসরি মানুষের উপকারে এসেছে। তার মধ্যে রাস্তাঘাটের উন্নতি বা ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান আছে, দু’টাকার চাল, সাইকেল, নানাবিধ ভাতাও আছে। দ্বিতীয় সারিভুক্ত পরিষেবাগুলিকে খয়রাতির কুনীতি বলে তকমা দেওয়াই যায়। খয়রাতি করে দীর্ঘমেয়াদে কোনও উন্নয়ন হয় না, একটা পর্যায়ের পরে খয়রাতি চরমে পৌঁছে যেতে বাধ্য, সেটাও সত্যি। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়টায় গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষ, যাঁরা এ রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁরা যে মমতাকে আশীর্বাদ করবেন, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।

নিজেদের পুঁথিগত বিদ্যার অহংকারে যাঁরা মমতার গরমেন্ট-সুলভ সুভাষিতানিকে প্রতিদিন ব্যঙ্গ করে এসেছেন, তাঁরা ভুলে গিয়েছেন, শিল্পসাহিত্যের চর্চা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দক্ষ প্রশাসক বানায়নি। মমতার বাচনশৈলী দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধির পরিমাপ করতে যাওয়াটা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়। ভোট পরিসংখ্যানের আঁকজোকে আর যাই হোক মানুষের মনের গতি ধরা যায় না। আঁকজোকের বাইরে তাকালে দেখা যায়, মমতা চার বছরে চারশো বছরের কাজ না করে থাকুন, চার বছরে কিছু কাজ করেছেন। রাজ্য জুড়ে দক্ষতার সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ‘বেনিফিশিয়ারি’ তৈরি করতে পেরেছেন। একে ভোটের রাজনীতি বলে গাল পাড়ার যুক্তি নেই। কারণ, ভোটের রাজনীতি করাই রাজনীতিকের কাজ। সকলেই তা-ই করে থাকেন। নারদ ভিডিয়ো নিয়ে যে প্রচার, সেটাও ভোটেরই রাজনীতি। নইলে দু’বছরের পুরনো ভিডিয়ো ভোটের মরসুমে বাইরে আসত না!

মানুষ এই দু’রকম ভোটের রাজনীতির মধ্যে একটিকে বেছে নিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতারা টাকা খাচ্ছেন, এটা কোনও নতুন কথা বলে তাঁদের মনে হয়নি। সারদা লাটে ওঠায় যখন তাঁদের পেটে লাথি পড়েছিল, তখনও তাঁরা মমতার থেকে মুখ ফেরাননি। পঞ্চায়েত এবং লোকসভায় তা আগেই প্রমাণিত। তাঁরা মনে করেছিলেন, নেতা-মন্ত্রীরা কে কত টাকা লুটেছেন তা ভেবে লাভ নেই। কিছু টাকা যদি ফিরে পাওয়ার আশা থাকে, ফেরালে মমতাই ফেরাবেন। দিন আনি-দিন খাই জীবনের লজিক এ রকমই হয়। সেটা পারসেপশনকে আঁকড়েই এগোয়। পারসেপশন আর বাস্তবে ফারাক থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে পারসেপশনকেই অবাস্তব ভেবে নেওয়াটা মূর্খামি।

এই মূর্খামির পরিচয়টাই বামেরা দিয়েছেন। জোট করে তাঁরা এতটাই উল্লসিত হয়ে পড়লেন, তাঁদের কথা শুনে মনে হতে লাগল ২০০৮-২০০৯-২০১১— সবই ছিল ফ্লুক। দুর্বল মুহূর্তে মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে সায় দিয়ে ফেলেছিলেন, এ বার সুযোগ পাওয়ামাত্র সে ভুল শুধরে নেবেন। এটা ঠিকই যে, নিজের সরকারের যে কোনও কুকীর্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠামাত্র মমতা যে ভাবে ৩৪ বছরের জিগির তুলে থাকেন, সেটা অত্যন্ত ক্লান্তিকর এবং বিরক্তিকর। কিন্তু এটাও ঠিক, মমতার আমলে গণতন্ত্রের পক্ষে অশুভ যে সব দুর্লক্ষণ বারে বারে ফুটে বেরিয়েছে, এক ব্যক্তিসর্বস্বতা ছাড়া প্রায় কোনওটিই অচেনা বলা চলে না। বাম জমানাতে মানুষ সে সব ঢের ঢের দেখেছেন। শাসকের দাদাগিরি, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, আমরা-ওরা, শিক্ষাঙ্গনে দলবাজি, ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি— কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবেন! বৈদ্যুতিন ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এ সব নিয়ে চর্চার পরিসরটি অনেক ব্যাপ্ত হয়েছে, যা বাম আমলের একটা বড় সময় জুড়ে অনুপস্থিত ছিল।

এ কথা বলার উদ্দেশ্য গত পাঁচ বছরের সালতামামিকে কোনও বৈধতা দেওয়া নয়। খালি এই বাস্তবটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়া, বামেদের নিজেদের হাতেই এত পাপ লেগে আছে যে তাঁরা অন্যের পাপ নিয়ে কথা বললে মানুষের মনে প্রভাব পড়ছে না। অন্তত এত তাড়াতাড়ি নয়। ফলে তাঁরা বারংবার বাংলার আকাশে যে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখে গলা ফাটালেন, সাধারণ মানুষ তাকে ততখানি দুর্যোগ বলে মনে করলেন না। এমনকী খাস কলকাতাতেও না। তার জন্য মানুষকে অন্ধ মনে করার কোনও কারণ নেই। তা হলে তৃণমূলের এই বিপুল জয়ের বাজারেও এতগুলো নক্ষত্রপতন ঘটত না। মমতার নিজের জয়ের ব্যবধান অর্ধেকের বেশি কমে যেত না।

আর একটা বাস্তবকেও বামেরা মনে রাখেননি। তাঁদের হাতে গড়া সিস্টেমই আজ তাঁদের মারছে। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টতা এই যে, এখানে পার্টি, প্রশাসন ও জনসমাজের মধ্যেকার ভেদরেখাগুলো বড় অস্পষ্ট। বামেরা ধৈর্য ধরে একটু একটু করে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে একে অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখানে ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা থেকে হাসপাতালে বেড পাওয়া, চাকরি জোটানো থেকে সরকারি পরিষেবা আদায়— সর্বত্র পার্টিকে ধরতে হয়। পার্টির খাতায় নাম না তোলালে কিচ্ছুটি হওয়ার জো নেই। গ্রামাঞ্চলে তো নয়ই। রোজকার যাপনের প্রতিটি পদে এই পার্টি-নির্ভরতা আর পাইয়ে দেওয়ার রেওয়াজ পাকাপোক্ত করেই বামেরা ৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন রাজত্ব বজায় রেখেছিলেন। বৈজ্ঞানিক রিগিং বা সন্ত্রাস সব সময় দরকার হয়নি। জীবনধারণের সিস্টেমটি যাতে এলোমেলো না হয়ে যায়, কেবল সেটুকু নিশ্চিত করার জন্যই মানুষ ভোট দিতে বাধ্য থেকেছেন। পালাবদলের পর্ব থেকে এই সিস্টেমটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বই তৃণমূল নিয়েছে। বা এমনটাও বলা যায়, ওই কালপর্ব থেকে মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে, তৃণমূল এ বার দায়িত্বটা নেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। সেই বিশ্বাসই ভোটবাক্সে জোড়াফুল ফুটিয়েছে। ২০০৮ থেকে পর্যায়ক্রমে দল বদলানোর ঢল নেমেছে। শুধু মারামারি থেকে বাঁচতে নয়, জীবন-জীবিকার স্বার্থে। এত বহুস্তরী সিস্টেম হুটহাট হাতবদল করা যায় নাকি? সময় লাগে। লম্বা সময় লাগে। মমতা তো সিস্টেমকে ধংস করেননি। সিস্টেমে নিজের দখল কায়েম করেছেন। যে সিস্টেম বামেদের ৩৪ বছর দিয়েছে, মমতাকে অন্তত ১০ বছর দেবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE