রোষ বা ক্ষোভ হয়ত সংগত কারণেই। কিন্তু তার প্রকাশ বেশ অসংগত ভঙ্গিতেই।
পর পর ঘটে গেল ঘটনাগুলো। দেখে মনে হল, বিস্ফোরক মজুতই ছিল, স্ফূলিঙ্গ মিলছিল শুধু, স্ফূলিঙ্গ পেয়েই দাউদাউ করে উঠল আগুন।
কারমেল প্রাইমারি স্কুলের ঘটনা আমরা সবাই দেখলাম। একটা জঘন্য অভিযোগ উঠেছে। তার প্রেক্ষিতে অভিভাবকদের রোষ আছড়ে পড়েছে। কিন্তু রোষটা আছড়ে পড়ল কী ভাবে? আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রবল অবনতিকে সাক্ষী রেখে। অভিযুক্তকে মারধর করার চেষ্টা হল, পুলিশের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হল, না পেরে পুলিশের উপরেই আক্রমণ হল।
টালিগঞ্জ-গড়িয়া রুটের অটো কী ভাবে বন্ধ হয়ে গেল, আমরা দেখলাম। তিরিশ ঘণ্টা বন্ধ রইল পরিষেবা। এক অটোচালকের বিরুদ্ধে যাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে। থানায় অটোচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ যাতে দায়ের না হয় তা নিশ্চিত করতে অটো ইউনিয়ন কী ভাবে ঝাঁপিয়েছিল, তা আমরা দেখেছি। অভিযোগকারিণী এবং তাঁর ছেলে যখন থানার ভিতরে, বাইরে তখন অটোচালকদের কী রকম মূর্তি, সে ছবি সংবাদমাধ্যম হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। ‘থানা থেকে বার হলেই ছিঁড়ে খাব’— এমন মন্তব্যও পুলিশের সামনেই ছুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ঘটনা আরও আছে। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে কী ভাবে জনরোষ আছড়ে পড়ছে, কী ভাবে পুলিশ আক্রান্ত হচ্ছে, কী ভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা আমরা প্রায় রোজই দেখছি। কখনও সরকারি বাসের চাকায় পথচারীর পিষে যাওয়ার ঘটনায়, কখনও হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায়, কখনও আবার জি ডি বিড়লা বা এম পি বিড়লা স্কুলের মতো ঘটনায়— বার বার বেলাগাম হয়ে প়ড়ছে জনসাধারণের আক্রোশ। রোষ বা ক্ষোভ হয়ত সংগত কারণেই। কিন্তু তার প্রকাশ বেশ অসংগত ভঙ্গিতেই।
জনরোষের এ অসংগত প্রকাশ তথা আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা তথা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি— এ পরিস্থিতি দু’টো কারণে জন্ম নিতে পারে। প্রথম কারণ, প্রশাসনের উপর আস্থা না থাকা। দ্বিতীয় কারণ, পুলিশ-প্রশাসনকে সমীহ না করা।
প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা সম্পূর্ণ উঠে গিয়েছে, এমনটা বলা সংগত হবে না। অভাব-অভিযোগ নিয়ে এ দেশে এখনও প্রশাসনেরই দ্বারস্থ হন মানুষ, প্রশাসনের দরজায় গেলে সুবিচার পাওয়া যাবে বলে অধিকাংশ মানুষই আশা রাখেন, সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোও এ দেশে স্বমহিমায় অস্তিত্বশীল এবং ক্রিয়াশীল। জনসাধারণের আস্থা পুরোপুরি উঠে গেলে এই ছবিটা সম্ভবত থাকবে না।
অতএব পড়ে রইল দ্বিতীয় কারণটা— পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি সমীহ কমছে জনসাধারণের। সমীহ যে কমছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ছোট-বড়-মাঝারি নানা ঘটনায় যে ভাবে জনতা আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, যে ভাবে নির্দ্বিধায় আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, আইনের রক্ষকদের কেউ আর খুব একটা ভয় পাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন
থানা থেকে বার হলেই ছিঁড়ে খাব, উড়ে এল শাসানি
কোথাও জনরোষ আছড়ে পড়া মানেই পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি নাগরিকের সমীহ সম্পূর্ণ উবে গেল, এমনটা নয়। কোনও ঘটনার আকস্মিকতা বা বীভৎসতা জনরোষের জন্ম দিতেই পারে। কিন্তু সেই ধরনের আকস্মিক ক্ষোভ বিচ্ছিন্ন ভাবে জন্ম নেয়, মাঝে মধ্যেই দেখা যায় বা আছড়ে পড়ে, এমনটা নয়। আমরা কিন্তু পর পর প্রায় প্রতিটি অবকাশে জনরোষকে বেলাগাম হয়ে আছড়ে প়ড়তে দেখছি। অর্থাৎ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। ঘটনাগুলো একটা নির্দিষ্ট প্রবণতার অঙ্গ।
পুলিশ-প্রশাসনকে সমীহ না করার এই প্রবণতা কেন? অপরাধ করলে বা আইন হাতে নিলে পার পেয়ে যাওয়া যায়, প্রশাসন ঈষৎ ক্ষমাশীল অবস্থান নেয়, সে ক্ষমাশীলতার মধ্যে ঈষৎ প্রশ্রয়ের বার্তা থাকে, প্রশাসনিক শৈথিল্যের ইঙ্গিত থাকে— এই রকম একটা ধারণা চারিয়ে গিয়েছে বলেই, সমীহটা উবে গিয়েছে। অপরাধ বা আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাকে প্রশাসন একটুও শিথিল ভাবে দেখবে না, এ বার্তাটা যদি জনমানসে থাকত, তা হলে কথায় কথায় জনরোষ এ ভাবে বেলাগাম হয়ে উঠত না। যে কোনও অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রেক্ষিতে জনসাধারণের বল্গাহীন প্রতিক্রিয়া যে সুখকর হচ্ছে না, পরিস্থিতি যে দিন দিন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, প্রশাসন নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছে। সে ক্ষেত্রে শৈথিল্য কাটাতে হবে অবিলম্বে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার যে কোনও ঘটনাতেই প্রশাসন যে কঠোর পদক্ষেপ করবে, সেই বার্তা সর্ব স্তরে পৌঁছে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে ভবিষ্যৎটা আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy