সকল পরিবর্তন শোরগোল করিয়া আসে না। পাভলভ মানসিক হাসপাতালের পঞ্চাশ জন সুস্থ আবাসিক যে ভোটাধিকার পেলেন, তাহা এক নীরব বিপ্লব। ওই পঞ্চাশটি ভোটার কার্ড বস্তুত মনোরোগ এবং মনোরোগী সম্পর্কে রাষ্ট্রের অবস্থান বদলের সনদ। কাহারও এক বার মনোরোগ হইলে তাঁহাকে স্বাভাবিক জীবন হইতে বাতিল করিতে হইবে, এমনই মনে করে সমাজ। তাই এক বার যাহাকে ভর্তি করা হইয়াছে মানসিক হাসপাতালে, চিকিৎসায় সুস্থ হইলেও তাঁহাকে আর ঘরে ফিরাইতে নারাজ আত্মীয়-পরিজন। রাজ্য তথা দেশের প্রতিটি মানসিক হাসপাতালে এমন অনেক মানুষ রহিয়াছেন, যাঁহারা সুস্থ কিন্তু গৃহহীন। তাই হাসপাতালই তাঁহাদের আশ্রয়। এই বার হাসপাতালের ঠিকানাকেই সেই আবাসিকদের ঠিকানা বলিয়া নথিভুক্ত করিল নির্বাচন কমিশন। আগামী সাধারণ নির্বাচনে মানসিক হাসপাতালের এই আবাসিকরাও ভোটদান করিবেন। তাঁহাদের সেই অধিকার দিয়া রাষ্ট্র বুঝাইল, মনোরোগ অপরাপর রোগের ন্যায় চিকিৎসাযোগ্য। চিকিৎসার ফলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়া আসিবার ক্ষমতা রহিয়াছে মনোরোগীর। সেই ক্ষমতার স্বীকৃতি না দিলে তাঁহাদের প্রতি অপরাধ করা হয়। সর্বোপরি, মনোরোগীও নাগরিক, অসুখ হইলে তাঁহার অধিকার নষ্ট হইয়া যায় না। তাঁহার যেমন চিকিৎসা পাইবার অধিকার আছে, তেমনই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারও অটুট থাকিয়া যায়। ভোটার কার্ড মনোরোগীর অধিকারের স্বীকৃতির প্রথম ধাপ মাত্র।
রাষ্ট্র তথা সমাজের বৃহত্তর কর্তব্য, মনোরোগীদের অর্থনৈতিক স্বাধিকার ফিরাইয়া দেওয়া। মনোরোগ দেখা দিলেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার কার্যত বাতিল করিয়া দেয় পরিবার। বহু ক্ষেত্রে পরিবারের কোনও সদস্যকে প্রতারিত ও বঞ্চিত করিতেই তাহার মধ্যে মনোরোগের সৃষ্টি করা হয়। আর একটি বৃহৎ সমস্যা, সন্তানের অভিভাবকত্ব অস্বীকার করা। বিশেষত কোনও মহিলার মনোরোগ দেখা দিলে তাঁহার সন্তানদের উপর অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হইয়া থাকে। এমনকি রাষ্ট্রও এই দোষে অভিযুক্ত। গর্ভবতী মনোরোগী হাসপাতালে ভর্তি হইলে তাহার প্রসবের সময়ে মা হইতে সন্তানকে জোর করিয়া বিচ্যুত করা হইয়া থাকে। ইহা অমানবিক এবং বেআইনি। এই সকল কাজের মূলে রহিয়াছে একটি ভ্রান্ত ধারণা যে, মনোরোগী কোনও প্রকার সিদ্ধান্ত লইতে সম্পূর্ণ অক্ষম। ইহার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক বৃত্তে থাকিয়া রোগী দৈনন্দিন কর্তব্য সকলই সমাধা করিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কথায় বা ব্যবহারে অপরদের তুলনায় কিছু অসাধারণত্ব থাকিতে পারে। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, তিনি নিজের যত্ন বা সন্তানের যত্ন করিতে অক্ষম।
মনোরোগীকে সমাজের মূলস্রোত হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার যে প্রচলন রহিয়াছে, তাহা বন্ধ করা প্রয়োজন। মনোরোগী ও মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষরাও আমাদের প্রতিবেশী, তাঁহাদের সাদরে গ্রহণ করিতে হইবে। তাঁহাদের অধিকারের মর্যাদাও দিতে হইবে। মনোরোগীকে সকল সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিবার সুযোগ দিতে হইবে। সবার সহিত লাইনে দাঁড়াইয়া ভোট দিবার কাজটি তাহার শুভারম্ভ মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy