দল-শ্রীবৃদ্ধি: বিজেপি সংসদীয় বৈঠকে সভাপতি অমিত শাহকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, দেখছেন আডবাণী, দিল্লি, ১০ অগস্ট। ছবি: পিটিআই
নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে প্রায়ই সপ্তাহান্তে আমদাবাদ যেতাম। বিশেষ বিমানে আডবাণী পৌঁছলে তাঁকে স্বাগত জানাতে মোদী নিজেই বিমানবন্দরে হাজির হতেন। কেশুভাই পটেলকে সরিয়ে সবে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। একদম টগবগ করে ফুটছেন। নানা ধরনের কর্মসূচি। নানা নতুন ভাবনা। কেশুভাইয়ের বার্ধক্যের ভারও ছিল, গতিও ছিল মন্থর। সেবার গুজরাতে প্রথম থ্রিডি সিনেমা হল উদ্বোধন হল। আমরা সব থ্রিডি চশমা লাগিয়ে প্রথম প্রদর্শিত ছবিটি দেখলাম। এখনও মনে আছে, ছবিটির বিষয় ছিল অচেনা সমুদ্র।
সমুদ্রের গভীরে অজানা কত প্রাণী। হঠাৎ দেখি একদল মাছ! মনে হচ্ছে গায়ের উপরে এসে পড়বে। পিছনের সারিতে বসে আডবাণী, তাঁর কন্যা প্রতিভা আর স্বয়ং মোদী। মোদীজি বললেন, ‘আডবাণীজি, এ বার মনে হচ্ছে জয়ন্তর দিল্লির বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে এসে গিয়েছি! এত মাছ কোথায় পাবেন!’ সবাই হেসে উঠলেন। সে দিনই দিল্লি ফেরার জন্য রওনা দিচ্ছি, মোদী রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত হারিন পান্ড্যকে বললেন, আডবাণীজিকে সি অফ করতে যেতে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কোথায় চললেন?’ মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘এখনই শিল্প নিয়ে বৈঠক আছে। টাটা অম্বানী সব আসছেন।’ তখনও ভাইব্র্যান্ট গুজরাত শুরু হয়নি। এর কয়েক বছরের মধ্যেই রাজ্যের শিল্পচিত্রটাই বদলে দিলেন তিনি। তিন দশকে নিজের চোখে দেখেছি কী ভাবে তিনি গুজরাতকে এক নতুন গুজরাতে পরিণত করলেন।
২০১৪। মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন। অন্য অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল গোধরার অতীতকে দূরে সরিয়ে গোটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবেন মোদী। মোদী নিজেও বার বার বলেছেন, দিল্লিতে খুব সামান্য কিছু লোক রয়েছেন যাদের ‘মোদী পচতা নেহি হ্যায়’। ‘গোটা দেশের মানুষ ভোট দিয়ে জেতাচ্ছে কিন্তু ওঁরা আমাকে গোধরাতেই আটকে রাখতে চান।’
তিন বছর অতিবাহিত। এখনও আমি বলছি, মোদী দেশের জন্য ভাল করতে চান না এমন নয়। বরং ভাল কাজ দেখিয়ে ২০১৯ সালে ফিরতে চান। কাজের মানুষ তিনি। চুপচাপ বসে থাকতে দেখিনি কখনও। অনেক নেতা যেমন আড্ডা পরচর্চা খানাপিনা নিয়ে থাকেন, উনি কিন্তু তা নন। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় জানেন? তিন বছর পর এখন মনে হচ্ছে মোদীজি যতই চান, নতুন ভারত গঠনের স্বপ্ন প্রদর্শন ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এস ওয়াজেদ আলির ভারতবর্ষের সেই মুদির দোকান। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।
নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। শিব গড়তে বাঁদর? স্তাবক ছাড়া যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই বলছেন, ‘মোদীজি আপনি তো বলেছিলেন এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশে কালো টাকার সঞ্চয় বন্ধ হবে। কালো টাকা উদ্ধার হবে। কালোবাজারিদের চিহ্নিত করা হবে। আমরা ক্যাশলেস বা লেস ক্যাশ সমাজে পৌঁছব। ডিজিটাল বিনিময় প্রথা আসবে। বাস্তবে কী হল?’
সে দিন খান মার্কেটে দেখলাম সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন এক সাংসদ ছ’হাজার টাকার জিনিস কিনে দু’হাজার টাকার বড় বড় গাড্ডা বের করে গার্ডার খুলে টাকা দিচ্ছেন। পুরনো অভ্যাস যাবে কোথায়! দাও ফিরে বিনিময় প্রথা! কালো টাকা ধরা পড়ল কোথায়, সবই তো সাদা হয়ে গেল। মোদী-উবাচ বদলে দিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী বললেন, কালো টাকা ধরাটা নাকি নোট বাতিলের উদ্দেশ্য ছিলই না। আর এখন তো সবাই বলছেন উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে মায়াবতী মুলায়ম কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলের ক্যাশ টাকার তহবিলে আঘাত হানার নির্বাচনী লক্ষ্যই ছিল নোট বাতিলের আসল উদ্দেশ্য। রাস্তাঘাটে অটো রিকশা চালক থেকে ছোট দোকানদার সবাই এ কথা বলছেন। মোদীজি, আপনি এখন ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে থাকেন। রাগ করবেন না। মনে হয় আপনার বশংবদ গোয়েন্দা আর রাজনৈতিক নেতারা এই খবর দিচ্ছেন না।
আসলে এখন মনে হচ্ছে মেরুকরণের রাজনীতির সঙ্গে বিজেপি-র সহবাস চিরন্তন। আডবাণীর বিতর্কিত পাকিস্তান সফরে সঙ্গে ছিলাম। ফেরার সময় আডবাণী বলেছিলেন, বিজেপি-র যাত্রাপথের অভিমুখ ধর্মনিরপেক্ষ। রামমন্দির মানে আসলে ভারতমাতার মন্দির। আমরা অনেক সময়ই কান দিয়ে সাংবাদিকতা করি। আমাদের খবরের উৎসের প্রতি আমাদের ভক্তি অনেক সময়, সত্যান্বেষণে বাধার কারণ হয়।
আজ আরও স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিজেপি-র রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিও যেমন ওঁর হাত দিয়ে হয়েছে, ঠিক সে ভাবে রামমন্দির আন্দোলন থেকে বাবরি মসজিদ ভাঙন, এই মেরুকরণের রাজনীতির যাত্রার শুরুও কিন্তু আডবাণীর হাত ধরেই। নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহের গত তিন বছর, এই যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায়। মুজফফরনগর থেকে দাদরি, এমনকী পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা, অসমের জয়লাভের নেপথ্য রণকৌশল, এ সবই ‘আর্ট অব ওয়র’। আজ দ্বিধাহীন ভাবে বলতে চাই, উন্নয়ন আর হিন্দুত্ব, দুটো একসঙ্গে সম্ভব নয়। একে অন্যের পরিপূরক নয়, বিপরীত। দলের ভিতরে ও বাইরে সমস্ত প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে যে ভাবে মোদী প্রধানমন্ত্রী হতে সক্ষম হয়ে তিনি একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করে থাকতে পারেন। কিন্তু নতুন ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি স্লোগান-সর্বস্বতা ছাড়া কিছু ছিল না। বিজ্ঞাপনের মোহজালে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট-এর রণকৌশল ছাড়া কিছু ছিল না। দেশের ভাল হবে বলে প্রধানমন্ত্রী যা করতে চান, তার জন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রস্তুত কি না সেটা কি তিনি খোঁজ করে দেখছেন? মানুষ সেটা ঠিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন কি না, সেটা বোঝার কি কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই? ঐকমত্য, আলাপ-আলোচনা এ সবই কি পরিত্যক্ত শব্দ? মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজাবেন শুনে ভেবেছিলাম যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়তো খোলনলচে বদলে দেবেন। কিন্তু সেখানেও হতাশ হলাম। এত গর্জনের পর বর্ষণ কোথায়? ঝুঁকি নেওয়ার সেই পরিচিত সাহস গেল কোথায়!
কমলাকান্ত বলেছিলেন কেউ কাঁঠাল খায়, আর কেউ তার গায়ে লেগে থাকা রস চাটে। কেউ পদ ও ক্ষমতার প্রত্যাশী, কেই আবার ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থে জো-হুজুর। তদন্তের ভয়ে নতজানু অনেকেই। কিন্তু সত্যান্বেষী সাংবাদিক যদি ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে সত্য পেশ না করেন, তবে তা ক্ষমাহীন অপরাধ। প্রধানমন্ত্রীরই শুধু মন কি বাত আছে, এমন তো নয়। সাংবাদিকরাও মনের কথা পাঠককে জানাতে চায়। সত্য সে কঠিন। কিন্তু সত্যকথনটা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy