অ-সভ্যতা। সলমন খানের মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ঠানে, মহারাষ্ট্র, ২৩ জুন। পিটিআই
সলমন খান তাঁর সাম্প্রতিক একটি ছবির শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, এক জন কুস্তিগিরের চরিত্র বাস্তব করে তোলাটা এতটাই কঠিন ও পরিশ্রমের ছিল যে, শুটিং শেষে তাঁর নিজেকে এক জন ‘ধর্ষিতা’ নারীর মতোই মনে হত। ব্যস, অমনি মিডিয়া থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সর্বত্র ঢি-ঢি পড়ে গেল, সলমন কত খারাপ, কত খারাপ। আরে! নিজেকে ধর্ষিতা নারীর সঙ্গে তুলনা করে তিনি যে ধর্ষিতাদের প্রতি কতটা সমবেদনা জানালেন, নিজেকে কতটা সহমর্মী বলে প্রমাণ করলেন, সেটা কিছু নয়? আসলে ক্ষুদ্র মানুষ আমরা, সব সময় বড় মানুষদের ভুলত্রুটি ধরে আকাশ বিদীর্ণ করাই আমাদের কাজ। বজরঙ্গি ভাইজানের বিশালতা বোঝা কি আমাদের ক্ষমতার চৌহদ্দিতে আছে?
নেই, মিস্টার ‘দাবাং’ খান। আমরা কেবল কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে তাঁর চলনটুকু দেখেই ক্ষান্ত থাকতে পারি না। অন্যের জীবনে উঁকিঝুঁকি দেওয়া স্বভাব তো আমাদের। তাই আমরা তাঁর ছিন্নভিন্ন হওয়া আত্মাটারও দু’এক ঝলক দেখতে পাই। সমাজ তাঁকে কত ঘৃণ্য, দুঃশ্চরিত্র, ব্রাত্য মনে করে সেটাও একটু-আধটু অনুভব করতে পারি। আমরাও অবশ্য এইটুকুই পারি। কারণ, এক জন ধর্ষিতার যন্ত্রণা সবটা বুঝতে পারা অন্য কারও পক্ষে সম্ভবই নয়। বিশেষ করে, সে মেয়ে তো কেবল এক বার বেআব্রু হয় না, চিরতরে বেআব্রু হয়ে পড়ে। তার আত্মা থেকে নুন-ছালটা চিরকালের মতো উঠে যায়। রোজকার রোদ-হাওয়া-জল লেগে সেটা জ্বলতেই থাকে। আর তাই আমরা যারা ছোট মানুষ, অতি সাধারণ, আমরা যারা মেলোড্রামা, তারা ধর্ষণকে এত সহজে নিতে পারি না।
হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই যে এখন মুড়িমুড়কির মতো ধর্ষণ হয়। তো, বেশি হয় বলেই কি তার যন্ত্রণা কমে যায়? না কি তা আমাদের এই স্পর্ধা জোগায় যে, ধর্ষণকে আর পাঁচটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারের স্তরে নামিয়ে আনতে পারি? না, পারি না। পারা উচিত না। কিন্তু নীতির কথা দিয়ে তো বাস্তব চলে না। আমরা দেখি বাস্তবে ধর্ষণকে হালকাফুলকা আড্ডার ভাষায় কিংবা আকর্ষণীয় বক্তব্যে রেফারেন্স হিসেবে দিব্য ব্যবহার করা যাচ্ছে। যেমনটা করেছেন বলিউডের মাচো হিরো।
আর তাই যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তার পরেও এক বারও মনে করেননি যে তিনি ভুল কিছু বলেছেন। কারণ ভুল স্বীকার করতে হলে একটা সংবেদনশীল মনের প্রয়োজন ছিল। যা তাঁর নেই। অনেক মানুষের অনেক কিছুই থাকে না। কী করা যাবে? মেনে নিতে হয়। তিনি হয়তো সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জড। মনের সংবেদনশীল তারগুলি হয়তো তাঁর ক্ষেত্রে কাজ করে না। অথবা কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করে, বাকি ক্ষেত্রে করে না। তবে কী, খামতি থাকলে মানুষজন তাকে অতিক্রম করার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সে প্রচেষ্টটাও দেখতে পেলাম না। তাঁর মন্তব্য নিয়ে এত সমালোচনার পরেও তিনি ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন মনে করেননি, কেবল মিডিয়ার জোরাজুরিতে বলেছেন, ‘এ বার আমার কথাবার্তা আরও সংক্ষিপ্ত করতে হবে।’ এর মানে কী? কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যটি করা উচিত হয়নি, না কি তিনি কম কথা বললে তাঁর কাণ্ডজ্ঞানহীনতা প্রকাশ্যে কম ধরা পড়বে? ভাবার বিষয়।
আসলে দোষ আপনার নয় সলমন খান। আপনাকে যে সমাজ তৈরি করেছে, যে সমাজ মাথায় করে নাচছে, সেই সমাজের উৎকৃষ্ট ফসল আপনি। পিতৃতন্ত্রের নিখুঁত সংজ্ঞা। অথবা আপনিই পিতৃতন্ত্র। যার প্রতাপ, প্রতিপত্তি, মানসিক চলন, সব আপনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। আপনার কাজকম্মে, আপনার ক্যারিশ্মায় উদ্বেল হয়ে ওঠে পিতৃতন্ত্রের পাঠ পড়া সমাজ। সবাই এটা পারে না। এ একটা অন্য রকমের ক্ষমতা। আপনি হয়তো ডিফরেন্টলি এব্ল।
এবং সেই ক্ষমতা ক্রমে উন্নততর হচ্ছে। এত দিন আপনার শরীরে, ভঙ্গিতে আপনি ছিলেন পুরুষ, যে একাই নির্মাণ করতে পারে পৌরুষের সংজ্ঞা। কিন্তু এখন আপনার মস্তিষ্ক, আপনার মনও সেই পৌরুষের প্রমাণ দিল, আমরা বুঝলাম যে, আপনি আত্মার কত গভীরে পিতৃতন্ত্রের ধারণাকে প্রোথিত করতে পেরেছেন। তা না হলে এত সমালোচনার পরেও আপনার এই নীরবতা সত্যিকারের পৌরুষ-পেডিগ্রির পরিচয় দেয়। সাধনা না থাকলে এ জিনিস হয় না।
এ সাধনা আপনার নয়। পিতৃতন্ত্রের। সে কত মনোযোগ দিয়ে আপনাদের মতো পুরুষকে গড়ে তোলে, যাঁদের ইংরেজিতে বলে ‘চোজ্ন ওয়ান’— তাঁরাই তো বহতা নদীর মতো ভাবধারাকে বয়ে নিয়ে যান, তাঁরাই তো আমজনতায় ছড়িয়ে দিতে পারেন ভাবনার বীজ, যা উপ্ত হয়ে সমাজ গড়ে ওঠে সেই ধারায়। যে সমাজে ছেলেরা, এমনকী ছেলেদের ‘স্মার্টনেস’-এর সমকক্ষ হয়ে ওঠার তাড়নায় ধাবিত মেয়েরাও কর্পোরেট মিটিংয়ে হাসি-ঠাট্টায় বলতে পারে, ‘ইফ ইউ কান্ট অ্যাভয়েড রেপ, এনজয় ইট।’ কিংবা বলে, ‘বিগ ডিল! একটা ছেলে জোর করে সতীচ্ছদ ফুঁড়ে দিল আর আমি অসতী হয়ে গেলাম? আমি এতই ফেলনা?’— কথাগুলো শুনতে বা পড়তে দারুণ স্মার্ট আর আধুনিক মনে হয়, কিন্তু ব্যাপারটা তত সহজ নয়। কারণ যে এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, ভাঙচুরটা তাকেই ভোগ করতে হয়। এই যন্ত্রণা আমরা বুঝি না, বোঝার চেষ্টা করি না। যেটুকু বোঝার চেষ্টা করি সেটা হয়তো বা বোঝার ভান। এক রকম ভাবে মনকে কতকগুলো মডেল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করা। সত্যি যদি বুঝতাম এ যন্ত্রণা, তা হলে তার তীব্রতার মাত্রা অনুভব করতে পারলে মূক হয়ে যেতাম। কোনও কিছুর সঙ্গেই তুলনা করার জায়গায় থাকতাম না। আর তাই যাঁরা কিছুটা বোঝেন এই যন্ত্রণা, এই অপমান, এই শূন্যতা, তাঁরা কেবল আপ্রাণ সমাজের মন পাল্টাবার চেষ্টা করে যেতে পারেন। সংবেদনশীল হয়ে ওঠার আর্জি জানাতে পারেন মাত্র। যেখানে কেউ এই কথাগুলো বলতে গেলেও দু-বার ভাববে। এমনকী সলমন খানও।
আচ্ছা, সলমন খানরা কি জানেন, বা মানেন, যে, পুরুষও ধর্ষিত হয়? পুরুষ যে ধর্ষিত হতে পারে, এ কথা তো সমাজ ওরফে পিতৃতন্ত্র মানতে পারে না। কারণে, তাতে তো পিতৃতন্ত্রের হার! কিন্তু মানলে, মানতে পারলে, সেই ধর্ষিত পুরুষকে নিয়ে পুরুষ এত সহজে মন্তব্য করতে পারবে তো? অথচ তারও কিন্তু একই রকম যন্ত্রণা হয়। শরীরে— সে’ও বোধ করি সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না, এবং মনেও— কারণ মনের শিরদাঁড়াটাও বেঁকে যায়। মিস্টার সলমন খান, যে দিন আপনি মানবেন যে পুরুষও ধর্ষিত হতে পারে, সে-ও ‘ভালনারেবল’, আর মন্তব্য করার সময় দেখবেন, ‘আই ফেল্ট লাইক আ রেপ্ড ম্যান’ কথাটা বলতেও জিভ সরবে না, সে দিন হয়তো বুঝবেন ধর্ষণ মানে কী।
তখন বোধ করি মাচো পুরুষ পৌরুষের সংজ্ঞা নতুন করে বুঝবেন। নারীত্বের অর্থও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy