সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করিয়াছেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইতে থাকিলে তাহাকে কি আর ‘ভুল’ বলা চলে? প্রশ্নেই উত্তর নিহিত। কংগ্রেসের সমর্থন লইয়া সীতারাম ইয়েচুরির রাজ্যসভায় যাওয়া আটকাইয়া গেল কেন্দ্রীয় কমিটির আপত্তিতে। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না হইতে দেওয়া, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির প্রেক্ষিতে ইউপিএ হইতে সমর্থন প্রত্যাহারের পর আবারও কংগ্রেসের প্রতি ছুঁতমার্গ সিপিআইএম-এর সিদ্ধান্তের মূল চালিকাশক্তি হইল। ইয়েচুরি ফের রাজ্যসভায় গেলেই যে এ কে গোপালন ভবনের মরা গাঙে ঢেউ খেলিয়া যাইত, তাহা নহে। কিন্তু সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে তো বটেই, এমনকী যে রাজ্যগুলিতে এক কালে দলের একচ্ছত্র দাপট ছিল, সেখানেও সম্পূর্ণ কোণঠাসা সিপিআইএম সংসদীয় রাজনীতিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হারাইল। ভুল? না কি, দলের অভ্যন্তরে কেরল লাইনের বিজয়পতাকা উত্তোলন? রাজ্য রাজনীতির সমীকরণে কেরলে কংগ্রেসের সহিত সিপিআইএম-এর প্রত্যক্ষ সংঘাত। সর্বভারতীয় স্তরে, বা বাংলার ন্যায় রাজ্যে, কংগ্রেসের সহিত হাত মিলাইলে কেরলে সিপিআইএম-এর সমস্যা হয় বটে। সেই কারণেই ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সহিত জোট লইয়া দলের অভ্যন্তরে বিপুল তর্কবিতর্ক চলিয়াছিল। সেই দফায় ‘বেঙ্গল লাইন’ জিতিয়াছিল, কিন্তু জয় স্থায়ী হয় নাই। প্রকাশ কারাট বুঝাইয়া দিয়াছেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে যিনিই থাকুন, পার্টি এখনও তাঁহার মতেই চলে।
কিন্তু, জনসমক্ষে কি আর এই কথা বলা চলে? অতএব, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তত্ত্ব খাড়া করিয়াছেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের এত কাজ যে তাঁহার পক্ষে সাংসদ পদের বোঝা বহন করা অসম্ভব। শোনা যাইতেছে, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগেই মুখ খুলিয়া বিজয়ন দলে বকুনি খাইয়াছেন। তবে, পার্টি তাঁহার বক্তব্যটিকেই ব্যবহার করিতেছে। কেহ অবশ্য প্রশ্ন করিতে পারেন, সিপিআইএম-এর অস্তিত্ব কোথায় যে তাহার সাধারণ সম্পাদককে দেশের এ প্রান্ত হইতে ও প্রান্ত ছুটিয়া কাজ করিতে হইবে? দশক তিনেক পূর্বেও দেশের বহু রাজ্যে সিপিআইএম-এর রাজনৈতিক উপস্থিতি ছিল। এখন, এমনকী একদা ‘দুর্জয় ঘাঁটি’ বাংলাতেও তাৎপর্যহীন হইবার দৌড়ে সিপিআইএম কংগ্রেসের সহিত পাল্লা দিয়া ছুটিতেছে। অটল দুর্গ জেএনইউ-এরও পতন হইয়াছে, সেখানে বামপন্থী রাজনীতির রাশ এখন অন্যদের হাতে। ইয়েচুরির আর কাজ কোথায়?
কেরল লাইনের আধিপত্য মানিয়া কংগ্রেসের প্রতি এই ছুঁতমার্গ দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৭৮ সালে জালন্ধর কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে কী ভাবে পড়িবেন, তাঁহারাই জানেন— কিন্তু তাঁহারা স্মরণে রাখুন, সেই ভারতও নাই, সেই কংগ্রেসও নাই। বরং, অযোধ্যা আছে, বিজেপি-র অপ্রতিরোধ্য উত্থান আছে। এই অবস্থায় ‘বুর্জোয়া’ শক্তির বিরোধিতা অপেক্ষা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী হইয়া উঠা সিপিআইএম-এর পক্ষে অধিকতর জরুরি ছিল। আদর্শের প্রশ্ন বাদ রাখিলেও কৌশলগত কারণেও অবস্থানটি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি দ্রুত বিজেপি-র দখলে যাইতেছে। রাজ্যবাসী দেখিতেছেন, গৈরিক বাহিনীর উত্থানে একমাত্র বাধার নাম তৃণমূল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি নহে। ফলে, ধর্মনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীর নিকটও কমিউনিস্ট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা থাকিতেছে না। কেরলের রাজনৈতিক বাধ্যবাধতকার পায়ে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সমর্পণ করিয়া দিলে দলের কতখানি লাভ, তাহা দল জানে, কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বিলক্ষণ ক্ষতি। কেরলের স্বার্থ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বেঙ্গল লাইনকে গুরুত্ব না দিলে এই রাজ্যে সিপিআইএম নামমাত্রও থাকিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy