Advertisement
০৪ মে ২০২৪
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একশো বছর
Jallianwala Bagh massacre

রবীন্দ্রনাথ চাননি জালিয়ানওয়ালাবাগের নামে ছড়িয়ে পড়ুক উন্মত্ত গণহিংসা

মনে রাখতে হবে, ১৯১৯-এ পাঞ্জাবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ যখন করছেন রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কাছে হিংসার অনৈতিকতার প্রসঙ্গটি কেবল দেশগত নয়, বৈশ্বিক।

নিহতদের শ্রদ্ধার্ঘে তৈরি স্মৃতিসৌধ । ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

নিহতদের শ্রদ্ধার্ঘে তৈরি স্মৃতিসৌধ । ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:৪২
Share: Save:

মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে যুদ্ধে নিহত তরুণ কবি উইলফ্রিড ওয়েনের মা সুজান এইচ ওয়েন রবীন্দ্রনাথকে, স্যর রবীন্দ্রনাথকে, ১৯২০ সালের ১ অগস্ট একটি চিঠি লিখেছিলেন। সুজান বোধহয় জানতেন না তাঁর পুত্রের প্রিয়তম ভারতীয় কবি তত দিনে স্যর উপাধি ত্যাগ করেছেন। ত্যাগ করেছেন পাশব হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই। লর্ড চেমসফোর্ডকে জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের পর লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I, for my part, wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those countrymen who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.’ চেমসফোর্ডকে যা লিখেছিলেন ইংরেজিতে স্নেহভাজন রানুকে তা জানিয়েছিলেন আপন ভাষায়, ‘কলকাতায় এসে বড়োলাটকে চিঠি লিখেছি – আমার ঐ ছার পদবিটা ফিরিয়ে নিতে।’ কেন ফিরিয়ে দিলেন? দেশের পরিস্থিতি, শাসকদের পাশবতা তাঁর ‘বুকের মধ্যে অনেক ব্যথা’ জমিয়েছে। ‘তাই ভারের উপরে আমার ঐ উপাধির ভার আর বহন করতে পারছি নে; তাই ওটা মাথার উপর থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

মনে রাখতে হবে, ১৯১৯-এ পাঞ্জাবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ যখন করছেন রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কাছে হিংসার অনৈতিকতার প্রসঙ্গটি কেবল দেশগত নয়, বৈশ্বিক। তিনি জানেন যে বিদেশিরা তাঁর দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন সেই বিদেশিরা যুক্তিহীন হিংসার পূজারী। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে বিদেশি মাত্রেই নরঘাতী। এ দেশের সাধারণ মানুষ যদি সে-কথা মনে করে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠেন তা হলে পাশবতারই জয় হবে। ১০ এপ্রিল পাঞ্জাবে মার্শাল ল ঘোষিত হওয়ার পরেই রবীন্দ্রনাথ খোলা চিঠিতে গাঁধীকে জানিয়েছিলেন, ‘পাশবশক্তি যে চেহারাতেই নিজেকে প্রকাশ করুক না কেন তার ভেতরে কোনও বিচারবোধ নেই, যুক্তি নেই। চোখে ঠুলি বাঁধা ঘোড়া যেমন অন্ধের মতো গাড়ি টানে, পাশবশক্তির গতিও তেমন।’ কথাটা সেই পরিস্থিতিতে উচ্চারণ করা খুবই শক্ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জানেন সত্য কঠিন। একালে দেশপ্রেমের মার-মারের মধ্যে কেউ যুক্তির কথা বললে যেমন তিনি অ্যান্টিন্যাশনাল এ-ও তেমন। রাওলাট আইনের বিরোধিতায় যে হরতাল চলছে তা যদি ক্রমশই যুক্তিহীন ইংরেজ বিরোধী প্রতিহিংসার পাশবতার রূপ ধরে তা হলে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

রবীন্দ্র-পরবর্তী পর্বে স্বাধীন ভারত উন্মত্ত জনতার হিংসার রূপ নানা সময় দেখেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মূল কারণই তো তাই। এক জনের কৃতকর্মকে সেই জাতি-বর্ণ-ধর্মের সকলের কৃতকর্ম বলে ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য দল। এক জন শিখ বা এক জন মুসলমান বা এক জন বর্ণহিন্দু হত্যাকারী হলে সমস্ত শিখ, সমস্ত মুসলমান বা সমস্ত বর্ণহিন্দুকে হত্যাকারী বলে দাঙ্গা লাগানো হয়, অথচ এ তো মানবতা বিরোধী। রবীন্দ্রনাথ সাবধান করে দিয়েছিলেন সে দিন, ‘দেখতে পাচ্ছি, ভয়ে হোক ক্রোধে হোক আমাদের শাসকসম্প্রদায়ের নখদন্ত আজ উদ্যত। এর ফলে আমাদের কেউ কেউ ব্যর্থ আক্রোশের চোরাগলিতে প্রতিহিংসার সুযোগ খুঁজতে বেরোবে, কেউ বা হতাশ হয়ে পথের মধ্যে বসে পড়বে।’ এই প্রতিহিংসার অত্যাচার আর হতাশের পলায়নপরতা, দুয়ের বাইরে যেতে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই এক দিকে শাসকের মূঢ় হিংসার প্রতিবাদে তাঁর নাইটহুড ত্যাগ, অন্য দিকে, তিনি জানেন ইয়োরোপ কেবল হিংসার উৎপাদক নয়। সেখানকার সাধারণ মানুষ নেশনের সঙ্গে নেশনের লড়াইতে হিংসার শিকার। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী। তা এক দেশের সমস্যা নয়। নেশনের সঙ্গে নেশনের সংঘাতই এই হিংসার কারণ। এই হিংসারই বলি তরুণ উইলফ্রিড ওয়েন। মা সুজান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, ‘এই পোড়া যুদ্ধ থামবার এক হপ্তা আগে আমার বুকের ধন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলে। যেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হল সেদিন এই নিদারুণ খবর এসে পৌঁছল আমাদের কাছে।…যুদ্ধে যে কোনো পক্ষেরই কোনো লাভ নেই – এ বিষয়ে আমার বাছার সংশয় মাত্র ছিল না।’ হিংসা সব দেশের মানুষেরই প্রাণ নেয়। রবীন্দ্রনাথ বার বার খেয়াল করিয়ে দিচ্ছিলেন পাশ্চাত্যের নেশনতন্ত্রই বিশ শতকে এই প্রাণঘাতী হিংসার সৃষ্টিকর্তা। পুঁজিবাদী নেশন ইয়োরোপে বিশ্বযুদ্ধ লাগায়, সাম্রাজ্যবাদের শিকলে ভারতকে বন্দি করে। পাশ্চাত্যের এই নেশনতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য সে দিন রবীন্দ্রনাথ তাকিয়েছিলেন ভারতীয় সভ্যতার অতীত অভিমুখে। রাষ্ট্রবুদ্ধি নয়, কূটনীতির অপকৌশল নয়, রবীন্দ্রনাথ মানেন অক্রোধ দিয়েই ক্রোধকে জয় করতে হয়। পাশব শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে কিন্তু সেই প্রতিবাদ যেন যুক্তিহীন প্রতিহিংসার ভাষা না হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: অনেক বেদনা, অনেক শৌর্য, অনেক গর্ব আর অনেক প্রশ্ন জাগায়

গাঁধীও তো মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন সেই কথা। তাঁর সত্যাগ্রহ নিতান্ত হরতাল নয়, লিখছিলেন তিনি। সত্যাগ্রহীর দায়িত্ব অনেক বেশি। পাশ্চাত্যের যে হরতাল তাতে হিংসা ও অস্ত্রের ব্যবহার থাকে। গাঁধী যে আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী তাতে বড় হয়ে ওঠে প্রাচ্যের অহিংস অতীত। রবীন্দ্রনাথ গাঁধী মনে করিয়ে দেন গৌতম বুদ্ধের কথা। গাঁধী জানান, সত্যাগ্রহী হিংসার পথে অস্ত্র হাতে অগ্রসর হন না। সত্যাগ্রহ অহিংস ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাই যখনই গাঁধী দেখেন সত্যাগ্রহ তার চরিত্র হারাচ্ছে, সত্যাগ্রহের ছদ্মবেশে হিংসা দানা বাঁধছে তখনই তিনি প্রত্যাহার করে নেন তাঁর আন্দোলন। সত্যাগ্রহের ছদ্মবেশে হিংসাকে পুষ্ট করার দলে যাঁরা নাম লেখান তাঁদেরকে গাঁধী আপন বলে মনে করেন না।

ইতিহাসে এই কুয়োরই উল্লেখ রয়েছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে নেওয়া।

শতবর্ষ আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের পাশব হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর এই কথাগুলি বড় তাৎপর্যময়। স্বাদেশিকতার বাণী তাঁদেরই দুজনের কণ্ঠেই প্রকাশ পেয়েছিল। দুজনের কেউই কিন্তু সেই স্বাদেশিকতাকে সহিংস জাতি-বিদ্বেষ ও অন্ধ দেশ-বন্দনায় পর্যবসিত করতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ যে কতটা ব্যথিত হয়েছিলেন তা জানা যায় প্রশান্তচন্দ্রের লেখা থেকে। সারারাত না-ঘুমিয়ে ছটফট করতে করতে লিখেছিলেন নাইটহুড ত্যাগের সেই বলিষ্ঠ পত্র। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে আহ্বান করতে বলেছিলেন প্রতিবাদ সভা। দিল্লি হয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন পাঞ্জাবে। এ সবই স্বাদেশিক রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ প্রচেষ্টা। কিন্তু কখনও চাননি জালিয়ানওয়ালাবাগের নামে ছড়িয়ে পড়ুক উন্মত্ত গণহিংসা। এ দেশের সমস্ত ইউরোপীয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ুক উন্মত্ত ভারতীয় জনতা, এ রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর কাম্য নয়, হতে পারে না। অথচ আজ যখন প্রতি মুহূর্তেই স্বাদেশিকতার সঙ্গে উগ্রতাকে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে, নির্বিচার দাঙ্গার আয়োজন চোখে পড়ে যে কোনও উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তখন মনে হয় এ বধ্যভূমি রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর দেশ নয়, হতে পারে না। দেশপ্রেমের ছদ্মবেশে হিংসাকে পুষ্ট করা সত্যাগ্রহের ছদ্মবেশে প্রতিহিংসাকে পুষ্ট করার মতোই অনৈতিক কাজ।

(লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE