অপরাধ?: অমিত শাহের ছেলে জয় শাহের বিরুদ্ধে বিজেপি অফিসের সামনে যুব কংগ্রেসের প্রতিবাদ। দিল্লি, ১০ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই
সুপারি জার্নালিজম। পরিভাষা নতুন। কপিরাইট এক বিজেপি নেতার। তিন বছরে অমিত শাহের ছেলের ব্যবসা কী ভাবে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে গেল, তা নিয়ে সাংবাদিক রোহিণী সিংহের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এই প্রতিক্রিয়া। অমিত-তনয় এই রচনার জন্য অনেক টাকার মানহানির মামলা করেছেন। আদালতের বিচারাধীন বিষয় এটি। কে ঠিক কে ভুল, তা বলছি না। কিন্তু দেশের সাংবাদিকতাকে সুপারি জার্নালিজম আখ্যা দিয়ে সাংবাদিকের সাহসী প্রয়াসকে ধমক দেওয়ার অপচেষ্টাকে ধিক্কার জানাই।
পয়সা দিয়ে কোনও পেশাদার খুনিকে নিযুক্ত করে কাউকে হত্যা করা হলে তাকে বলে সুপারি কিলিং। মুম্বইয়ের অপরাধ জগৎ ও বলিউডের সৌজন্যে শব্দটির জন্ম। কিন্তু সুপারি সাংবাদিকতার অর্থ কী? মোদী-শাহের ব্যক্তিগত সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে হত্যা করার জন্য টাকা দিয়ে সাংবাদিককে ভাড়া করা হয়েছে? রোহিণী সিংহই যখন সনিয়া গাঁধীর জামাতা রবার্ট বঢরার অবৈধ সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিলেন তখন এই বিজেপি নেতারাই তাঁকে নিয়ে ধন্য ধন্য করেছিলেন। তখন তো বিজেপি নেতাদের মনে হয়নি সেটি সুপারি জার্নালিজম! আসলে রাজনৈতিক নেতারা বিরোধী থেকে শাসক হলেই হয়ে যান লঙ্কার রাবণ।
সংবাদমাধ্যমকে যে ‘ফোর্থ এস্টেট’ বলা হয়, সেটা অকারণ নয়। সাংবাদিকরা শাসক দলের জনসংযোগ অধিকর্তা নন। সমস্যা হল, অনেক শাসক নেতাই তোষামোদীদের তৈলমর্দনে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মপ্রেমে নিমগ্ন হন। তখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, আপনি যদি পক্ষে লেখেন, অবিরাম শাবাশ! শাবাশ! করতালিমুখর সেই আবহে আপনি সাংবাদিক হিসাবে সরকারি খেতাবও পেতে পারেন। আর যদি সমালোচনায় মুখর হন, তৎক্ষণাৎ শাসক দলের দুশমন!
বাজপেয়ী-আডবাণীর সময়েও এতটা দেখিনি। মনে আছে, এক ইংরাজি দৈনিকের ডেপুটি এডিটর প্রতি দিন তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিরুদ্ধে লেখেন। সে সময়ে গোয়েন্দা কর্তারা রিপোর্ট দিয়ে আডবাণীকে বলেন, ওই সাংবাদিক মার্কিন নাগরিক। ওঁকে আর ভিসা না-ও দিতে পারে ভারত সরকার। দেশবিরোধী কার্যকলাপ, এমনকী ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তোলা যায়। আডবাণী ফাইলটি পড়ে সেটিকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বলেছিলেন, কেন এমন করব? জরুরি অবস্থায় জেল খাটা আডবাণী এহেন দমনপীড়নের রাজনৈতিক লাইন নিতে রাজি ছিলেন না। আর বাজপেয়ী তো এ সব ব্যাপারে ছিলেন আরও উদার। স্বাধীন চিন্তার এহেন বিরোধিতা, অন্য মতের প্রতি এমন অসহিষ্ণুতা দেখা যায়নি কখনও।
বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের সংবাদমাধ্যমের বিপুল সমর্থন যে পাননি তা তো নয়। ২০১৪ সালে তো অনেকেই বলেছি, মোদীই এ দেশে সম্ভাব্য ভবিষ্যত কান্ডারি। আমি নিজে বহু বার লিখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতাশাগ্রস্ত ব্রিটিশ সমাজে যেমন এক জন জেমস বন্ডকে দরকার ছিল, এ দেশে সত্তরের দশকের আর্থিক সংকটে চূড়ান্ত বেকারি ও দারিদ্রের পটভূমিতে এক জন অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অমিতাভ বচ্চনকে দরকার ছিল। ঠিক সে ভাবেই ভারত ইউপিএ জমানার হতাশার মধ্যে থেকে এক সুপারম্যানকে খুঁজছিল। মোদীই ছিলেন সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। আজও সংবাদমাধ্যমের এক বিশাল অংশ মোদীর নীতি ও দৈনন্দিন কার্যকলাপের উপর আস্থা রেখেই চলেছে। সমালোচনা করেন ক’জন?
তাই বলে আজ বলতে পারব না, দেশের আর্থিক নীতি ও বিদেশ নীতি দুটোই মুখ থুবড়ে পড়েছে? বললেই আমি সুপারি জার্নালিস্ট? সভাকবিরা সমস্বরে বলছেন, মোদী-বিরোধী হেট-ক্যাম্পেন ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরি হয়েছে, আসলে মোদীর জনপ্রিয়তা আজও একই ভাবে অটুট। তাঁদের বক্তব্য, দেশের মধ্যে কতিপয় বামপন্থী উদারবাদীরা আছেন যাঁরা নিজেরাই ভাবছেন ও লিখছেন মোদীর জনপ্রিয়তা খর্ব হয়ে গিয়েছে, এ এক ধরনের আত্মরতি। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে কিছু সাংবাদিক এ সব লিখে ভুল প্রমাণিত হন। ২০১৯-এও এই মোদী বিরোধী সংখ্যালঘু নাগরিক সমাজ আবার হতাশার শিকার হবেন।
অনেক পরিচিত বিজেপি নেতা আমাকে পরামর্শ দিচ্ছেন, এত বিরোধিতা করছ কেন? ২০১৯ সালে মোদীজিই ক্ষমতায় আসবেন। তখন টের পাবে। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মন্তব্য, ‘মোদীজি, অরুণ জেটলি ও বহু বিজেপি নেতা তোমাকে ভালবাসে। স্নেহ করে। এত বছর ধরে দিল্লি দেখছ। তুমি তা সত্ত্বেও বিরুদ্ধে লিখছ কেন?’
ঠিক এখানেই বিজেপির ভাবনার ভ্রান্তি। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিজেপি দলটি দিল্লিতে কভার করছি। বিজেপি নেতারা বহু দিন থেকে আমাকে দেখছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিকে আমি নিজেও সম্মান করি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দেশের আর্থিক অবস্থা খারাপ, চাকরিবাকরি নেই। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে মানুষ ক্ষুব্ধ, জিএসটির পরও এখনও পর্যন্ত বাজারের অবস্থা ভাল নয়। সাংবাদিক হিসাবে মাঠে-ঘাটে-বাটে, গিয়ে দেখছি বিদেশ নীতি নিয়েও মধ্যবিত্ত সমাজ বিরক্ত। সে কথাগুলি বলব না? চাটুকার অনুগ্রহপ্রার্থীরা বলতেই পারে দেশে ‘রানির শান্তি’ বিরাজমান। কিন্তু কারও যদি তা মনে না হয়, দুর্নীতির পরিচয় পেলে কোনও সাংবাদিকের কলম যদি দ্বিধাহীন ভাবে তা লেখে তবে সে সুপারি জার্নালিস্ট?
সবচেয়ে বড় কথা, ভোট জেতা-হারার সঙ্গে এই মূল্যায়নের কোনও সম্পর্ক নেই। সিপিএম ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। তখন আমরা যারা সিপিএমের অনাচারের বিরুদ্ধে সরব ছিলাম, তারা বলিনি তাদের শিক্ষা নীতি ঠিক ছিল। ভোটে জিতেছেন মানে রাজ্যে দলতন্ত্র ছিল, সে কথা কেউ বলেনি। গত উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের সময় ইলাহাবাদ ও সংলগ্ন কয়েকটি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে দেখেছিলাম অখিলেশ ও রাহুল জুটির গ্রহণযোগ্যতা ছিল অভূতপূর্ব। বিজেপি বিপুল ভোটে জেতার পরেও সেই চোখে দেখা উন্মাদনা অসত্য হয়ে যায়নি।
আসলে রাজনেতাদের সমস্যা হল, যখন ক্ষমতায় থাকেন, দলের বা নিজেদের জনপ্রিয়তার অবক্ষয় মানতে চান না। বিশ্বাস করতে চান না। উল্টে রেগে যান, ভাবেন সাংবাদিকরা ওঁদের শত্রু।
নন্দীগ্রামের পর মহাকরণের ঘরে বুদ্ধদেববাবুকে বলেছিলাম, গুলি চলার পর মমতা দ্রুত এগোচ্ছেন। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, মানুষ এত বোকা নয়। মানুষ জানে তৃণমূল মানে কী! ২০০৪ সালের ভোট পর্বে যখন বিজেপি ইন্ডিয়া শাইনিং শীর্ষক প্রচার চালাচ্ছে, আডবাণীকে বলেছিলাম, আপনারা যতই ‘ফিল গুড’ প্রচার করুন, কৃষকদের আত্মহত্যার খবরও আসছে। আডবাণী বলেছিলেন, হতে পারে অসন্তোষ কিছু বেড়েছে, কিন্তু আমরা সামলে নেব। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল কী হয়েছিল সেটা আমরা দেখেছি। আডবাণীও সামলাতে পারেননি।
মোদী ২০১৯ সালে আবার জিতবেন না কি রাহুল গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। কিন্তু তিন বছর পর সরকারের বিভিন্ন নীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে সমালোচনাই করতে পারব না? সমালোচনা মানেই ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। আমরা সুপারি সাংবাদিকতা করি না।
সুনির্মল বসুর একটি কবিতার শেষ লাইন ছিল, ‘বাঙ্গালি হয়েছো বাপু, পলায়ন শেখোনি’। অশোক মিত্র সেই কবিতার লাইনটি মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সত্তর বছর ধরে বাঙালি ক্রমশ কুঁকড়ে নিয়েছে নিজেকে। বাঙালি খ্যাপা বেড়ালের মতো নিজেকেই আঁচড়াচ্ছে আর কামড়াচ্ছে। আজ যখন সাংবাদিকের মুক্ত চিন্তা প্রকাশের উপর আঘাত আসছে, সাংবাদিকরা নিহত হচ্ছেন, তখন আমরা নিশ্চয়ই পালাব না। এটুকু আস্থা দিতে পারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy