অবশেষে: জনসভা উপলক্ষে এসেছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। পাটন, গুজরাত, ১৩ নভেম্বর ২০১৭। ছবি: পিটিআই
সে কালের রীতিতে মুঘল সম্রাট আকবরকে ডাকা হত জাহাঁপনা বলে। জাহাঁপনা শব্দের অর্থ হল, ‘বিশ্বের আশ্রয়’। নেতা সেই মানুষটি, যিনি প্রজার আশ্রয়স্থল। তাঁর সমর্থক, তাঁর প্রজা, তাঁর ভোটারকে রক্ষা করেন নেতা। ভারতীয় ঐতিহ্যে নেতা মানে শুধুই ক্ষমতা নয়, নেতা হয়ে ওঠা এক প্রক্রিয়া। ক্ষমতা একটা সাময়িক মাধ্যম। আসলে নেতৃত্ব মানুষের ভালবাসা থেকে গড়ে ওঠে, ক্ষমতা থেকে নয়। সবাই সত্যিকারের জাহাঁপনা হয়ে উঠতে পারেন না। কেউ কেউ পারেন, যেমন সম্রাট আকবর।
আজ যখন এই লেখাটি লিখতে বসেছি, সতীর্থ সাংবাদিক ২৪ আকবর রোডের কংগ্রেস ভবন থেকে ফোন করে জানাল, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এই বর্ষশেষেই রাহুল গাঁধী দলের সভাপতি হতে চলেছেন। সংসদ সদস্য হয়েছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে সহ-সভাপতি হয়েছেন, ধাপে ধাপে সেই তরুণই এখন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা হয়ে উঠলেন। মনে পড়ল, কিছু দিন আগে নেতৃত্ব নিয়ে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বার বার বলছিলেন, নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনি স্বতঃস্ফূর্ততায় আস্থা রাখেন, জবরদস্ত কঠিন কঠোর নেতার ‘হলোগ্রাম’ রচনায় বিশ্বাস করতে পারেন না। যাত্রাদলে রাজার পোশাক পাওয়া যায়। চিৎপুরে টিনের ট্রাঙ্কে রাখা থাকে টিনের তলোয়ার, রাজার মুকুট। সেই ঝলমলে রাংতা দেওয়া জরি আর ভেলভেটের রাজবেশ পরলেই রাজা হওয়া যায় না।
আজকের চলতি রাজনীতির বিপণন কিন্তু ভিন্ন। প্রতিপক্ষের চেয়ে বড় হওয়ার সহজতম রাস্তা কী? পুরনো গল্প, ব্যবহারে কিঞ্চিৎ ক্লিশে। তবু সেই গল্পটাই বললাম ওঁকে। দুটি উল্লম্ব সরলরেখা ‘ক’ এবং ‘খ’। ‘খ’-এর উচ্চতা কাঁচি দিয়ে অর্ধেক করে দিন, তা হলেই ‘ক’ বাবু লম্বা হয়ে যাবেন। আর একটি পথ আছে। অন্যকে ছোট না করে ‘ক’ বাবু নিজেই ‘খ’ বাবুর চেয়ে নিজেকে দীর্ঘ করে ফেললেন। দুঃসাধ্য জিনিসকে পাওয়ার সুখসাধ্য পথকে রবীন্দ্রনাথ ফাঁকির পথ বলেছিলেন। রাজনীতিতে সাংবাদিকতা করার দৌলতে খুব কাছ থেকে দেখেছি, বিজেপি শুধু ‘ব্র্যান্ড মোদী’র নির্মাণ নয়, পাশাপাশি নিরন্তর প্রচার চালিয়েছে যে, রাহুল গাঁধী হলেন ‘মাম্মির পাপ্পু’। এ প্রচারে বিজেপি যে দেশের মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে সে কথা রাহুল নিজেও স্বীকার করেছেন। তবু প্রচার অথবা অপপ্রচারের আঁধির মধ্যেও মনে করি, রাহুল অবিচল ছিলেন।
এখানে নিজেই একটা ‘ব্রেক’ কষে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছি, যা-ই বলুন আর তা-ই বলুন স্যর, রাহুল নিজেও কি তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলির জন্য অনেকাংশে দায়ী নন? কিছু দিন আগে মালদহে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনাসভায় গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ছাত্র অভিজিৎ দেব সরাসরি এ প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাহুল না কি সংসদের অধিবেশন হলে নিয়মিত যান না? গিয়েও শেষ বেঞ্চে ঘুমোন? প্রায়ই বিদেশে বেড়াতে চলে যান?
আমার জবাব হল, মানছি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে সে শরীরে ভাইরাস দ্রুত আশ্রয় নেয়। হতে পারে আজকের রাজনীতিতে যে ‘পারসেপশন’ তৈরির রণকৌশল, তাতে মোদীর চেয়ে রাহুল পিছিয়ে। সমস্যা, রাহুল তো ‘পারসেপশন’-এর রাজনীতির এই নির্মাণ-সংস্কৃতিরই বিপক্ষে। আমরা যদি অফিসে কাজ করতে করতে ছুটি নিতে পারি, তবে এক জন রাজনীতিকই বা নেবেন না কেন? বিরোধী দলে থাকার সময় প্রতিনিয়ত ক্যামেরার সামনে শিরা ফুলিয়ে বক্তৃতা দেওয়াও কাজ নয়। অনেকেই জানেন না, দলের ভিতর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাহুল কী ভাবে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সনিয়া যখন দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখনও তাঁকে অনেক বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপের মুখোমুখি হতে হয়। শরদ পওয়ার থেকে সাংমা-রাজেশ পাইলট কী ভাবে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বেরিয়ে আলাদা দল গড়েছিলেন, এখনও মনে পড়ে। অর্জুন সিংহ থেকে নটবর সিংহ— অনুগামী থেকে বিদ্রোহী হলেন কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগায়। সীতারাম কেসরী কী করেছিলেন, সে সব দিনও দেখেছি চোখের সামনে। সনিয়া কিন্তু তাঁর শাশুড়ির সিন্ডিকেট-বিরোধী হিমশীতল প্রতিক্রিয়াহীন পাল্টা রাজনীতির কৌশলে সেই বিক্ষিপ্ত রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করেছেন। দশ বছরের মনমোহন সিংহের জমানায় শত প্রকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-অন্তর্কলহ থাকা সত্ত্বেও সনিয়া কংগ্রেসকে বেঁধে রেখেছিলেন নিপুণ ঐক্যে। রাহুলের নেতৃত্বেও সেই কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। বৃদ্ধতন্ত্র ফোঁস করতে পারেনি, তাঁদেরও রাহুল সঙ্গে রেখেছেন, বাতিল করেননি। আবার নবীন প্রজন্মের রাজ্যওয়ারি এক নেতৃত্বও গড়ে তুলেছেন।
এ সবই রাহুল করেছেন চুপচাপ। তার পরে, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এখন দেখছি রণসজ্জায় তৈরি রাহুল। যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে। তিনি শুধু কংগ্রেসের নয়, বিরোধী শিবিরেরও প্রধান মুখ। মনমোহন সিংহ তথা ইউপিএ জমানার সমালোচনায় মুখরিত হয়েছেন মোদী। কিন্তু রাহুলকে বিদ্ধ করতে পারছেন না। বরং, পাঠককে মনে করিয়ে দিই, মনমোহন বার বার বলা সত্ত্বেও সে দিন রাহুল মন্ত্রীও হননি। ২০১৪ সালের ভোটের আগে নেতৃত্বের কুর্সিতে তড়িঘড়ি উপবিষ্ট হননি।
মোদীর জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন করি না। হতে পারে, প্রকৃতির নিয়মে সেই জনপ্রিয়তায় ক্ষয় ধরেছে। তবু তিনি ক্যারিসম্যাটিক নেতা। কিন্তু ক্যারিসমা সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাসের শিক্ষা তা-ই। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নেতারা অনেক সময়েই এই ‘ডেট অব এক্সপায়ারি’র কথা মনে রাখেন না।
সম্প্রতি রাশিয়া সম্পর্কে অসাধারণ একটি বই পড়লাম। নেতৃত্ব নিয়ে লিখেছেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আর্চি ব্রাউন তাঁর ‘দ্য মিথ অব দ্য স্ট্রং লিডার’ নামক বইতে বলেছেন, অনেক সময় ক্যারিসম্যাটিক নেতার চেয়েও ট্রান্সফরমেশনাল অর্থাৎ রূপান্তরকারী নেতা সমাজে বেশি জরুরি। এই শ্রেণির নেতাদের চমক থাকে কম, কিন্তু তাঁরা নিঃশব্দে কাজের মধ্য দিয়ে, কখনও বিপ্লব কখনও সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনেন। এই নেতাদের জনপ্রিয়তা ঈশ্বরদত্ত না-ও হতে পারে। কিন্তু তাঁরা ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে দেশের নেতা হিসেবে নিজেদের নির্মাণ করেন। আর্চি ব্রাউন দীর্ঘ অর্ধশতক ধরে ইউরোপের নানা ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তিনি বলছেন, ‘নেতৃত্ব আসলে নানা ধরনের হয়। সময় এবং পটভূমির প্রেক্ষিতে নেতৃত্বের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।’
আমরা কেউই দুর্বল নেতৃত্বের প্রশংসা করি না। দুর্বল নেতা হওয়া মানেই নেতিবাচক বিষয়। কিন্তু শক্তিমান নেতার ‘মিথ’ ভাঙা প্রয়োজন বলে মনে করেন আর্চি ব্রাউন। তাঁর মনে হয়, ‘স্ট্রং’ নেতৃত্বের মাধ্যমেই একনায়কতন্ত্রের প্রবেশ হয়। রাহুল যদি ভারতের মতো বহুত্ববাদী নানা ভাষা-নানা মত-নানা পরিধানের দেশের প্রধান কান্ডারি হতে চান তবে আমি তাঁকে অনুরোধ করব, এই ২০১৭ সালে, দোহাই, তিনি এতটা শক্তিশালী না-ই বা হলেন যাতে স্টিমরোলার দিয়ে ভিন্ন কণ্ঠস্বরকেই স্তব্ধ করে দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy