Advertisement
১১ মে ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু

সাপকে বলা হয় ‘ছন্নদৃষ্টি’। এদের চোখের পাতা নেই। আছে কাচের মতো ঢাকনা যাতে ধূলিকণা আটকায়। সাপের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ না হলেও কোনও কিছুর নড়াচড়া বা আলো-ছায়ার পার্থক্য বুঝতে পারে।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সাপ নিয়ে সত্যমিথ্যা

‘পোষা সাপের ছোবলেই মরলেন ওঝা’ (মেদিনীপুর ও খড়্গপুর সংস্করণ, ৩-৭) শীর্ষক খবরের প্রেক্ষিতে বলতে চাই ‘পোষা সাপ’ কথাটাই অর্থহীন। কুকুর, বেড়াল, ছাগল, বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার ইত্যাদিরা পোষ মানতে পারে। কিন্তু সাপ ‘নৈব নৈব চ’। সাপ পোষ মানে না। ‘বাস্তুসাপ’ থাকতেই পারে, কিন্তু পোষ মানা নয়। ঘরে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায় ইঁদুরের খোঁজে। সাপের বোধবুদ্ধি বলে কিছুই নেই। মানুষ চেনা, স্মৃতিতে ধরে রাখা, প্রতিশোধ নেওয়া— কোনওটাই সাপের ধর্ম নয়। ব্রেন বা মস্তিষ্ক সাপের দেহের ওজনের তুলনায় অত্যন্ত ছোট, যার ওজন অতি নগণ্য। বিবর্তনের ধারায় সাপ হারিয়েছে পা, কান, চোখের পাতা, বাঁ দিকের ফুসফুস। এই দৈহিক পরিবর্তনগুলি যেমন হয়েছে, তেমনই মস্তিষ্কের বিকাশ হয়েছে সবচেয়ে কম। সরীসৃপকুলে সাপ বা সর্প সবচেয়ে নির্বোধ জীব। কিছু কিছু গবেষক অবশ্য কেউটে-গোখরোর বুদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী। অন্যদের তুলনায় এদের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স কিছুটা উন্নত।

সাপকে বলা হয় ‘ছন্নদৃষ্টি’। এদের চোখের পাতা নেই। আছে কাচের মতো ঢাকনা যাতে ধূলিকণা আটকায়। সাপের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ না হলেও কোনও কিছুর নড়াচড়া বা আলো-ছায়ার পার্থক্য বুঝতে পারে। কিছু সাপের মাথার কাছে বা ঠোঁটের উপর আছে ‘তাপচক্ষু’ যার সাহায্যে এরা উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের উপস্থিতি টের পায়। কষ্ট করে ঠাহর করতে হয় বলে শত্রু বা শিকারের দিকে একদৃষ্টিতে অনেক ক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাই ভঙ্গিটা হয়ে দাঁড়ায় অন্তর্ভেদী সম্মোহনী দৃষ্টির মতো। এই জন্যই সাপকে বলা হয় ‘চক্ষিশ্রবঃ’।

সাপের শ্রবণেন্দ্রিয় অকেজো, বহিঃকর্ণ নেই, কানের পিন্‌না, ইয়ারড্রাম, টিমপ্যানিক গহ্বর ইত্যাদি নেই। অর্থাৎ সাপ বধির। বেদেরা বাঁশি বাজিয়ে যে সাপ নাচায় সেটা সুরের নেশায় সাপকে মাতাল করে নয়, বাঁশি, হাত আর হাঁটুর দুলুনি দিয়েই তা সম্ভব। বধিরতা সত্ত্বেও সাপ অত্যন্ত সুবেদী প্রাণী। মুখের নীচে ফাটা চোয়াল-জোড়ায় এরা মাটির সূক্ষ্মতম কম্পনও টের পায়। প্রাণীতত্ত্ববিদরা মনে করেন, দাঁড়াশ (ঢ্যামনা), ময়াল ইত্যাদি কিছু জাতের সাপ পুরো বধির নয়। শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি পূরণ করে এদের তীব্র ঘ্রাণশক্তি। শুধু নাসিকা নয়, মুখের ভিতর টাকরায় থাকা ‘জেকবসন’স অর্গান’ ঘ্রাণ নেওয়ার কাজে সহায়তা করে। লকলকে চেরা জিভ বের করে ভাল-খারাপ সব রকম গন্ধই সাপ খুঁজে বেড়ায় সদাসর্বদা। সাপের লেজের কাছে পায়ুর পাশে এক ধরনের গন্ধগ্রন্থি আছে, সময়বিশেষে এখান থেকে বেরনো তীব্র কটু গন্ধের রসে আকৃষ্ট হয়ে সাপ খুঁজতে আসে সঙ্গীকে।

সাপ দুধ-কলা খায় না। সাপের জিভ চেরা বলে চুষে খেতে পারে না। সাপের তালুর গঠন চুষে খাওয়ার অনুকূল নয়। লেহন ও চর্বণের কোনও ক্ষমতাই সাপের নেই। সাপের শরীরের ডান দিক জুড়ে একটি ফিতের মতো ফুসফুস। যদিও ময়াল ও বোড়া জাতীয় সাপের দুটি ফুসফুস থাকে। শ্বাসের জোর কম থাকায় পান করার ক্ষমতা সাপের নেই। এরা জল চেটে চেটে খায়।

সাপ নোংরায় থাকে না। খুব সুখী প্রাণী। গর্তে একটা পিঁপড়ে বা মশা থাকলেও এরা বাইরে বেরিয়ে আসে। ঠান্ডা রক্তের অলস প্রাণী, গা বরফের মতো ঠান্ডা। শান্ত, নির্বোধ, নিরীহ, বধির, মাংসাশী এই প্রাণীটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর শিকার করে কৃষিকার্যে সহায়তা করে। একমাত্র নিজে বিপদে পড়লেই সাপ ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

পণ্ডিতদের মতে, পশ্চিম এশিয়ায় ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কেউ প্রথম সর্পপূজা করেছিল। এরা আর্য বা সেমেটিক গোষ্ঠী থেকে পৃথক। এদের কাছ থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ সর্পপূজা পদ্ধতি শিখে নেয়। যেমন, ভারতে সর্পপূজার প্রচলন হয়েছিল পারস্য থেকে। আবহাওয়া ও জলবায়ু ভেদে ভারতে নানান অংশে দুশোর বেশি প্রজাতির সাপ থাকলেও তার মোটামুটি ত্রিশ শতাংশ প্রজাতি বিষধর। সর্পাঘাতে মৃত্যুর শতকরা সত্তর ভাগ হয় নির্বিষ সাপের কামড়ে— হার্টফেল করে।

সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বেশির ভাগ সময় অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ওঝা বা গুণিনের উপর নির্ভর করার জন্য হয়ে থাকে। বিষধর সাপের কামড়ের একমাত্র চিকিৎসা অ্যান্টি-ভেনম ইঞ্জেকশন আর ক্ষতস্থানের জীবাণু সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিটিটেনাস। নির্বিষ সাপে কামড়ালেও অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়া উচিত। সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসাও বাড়িতে করা ঠিক নয়। অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, হাঁটিয়ে নয়, যে কোনও গাড়িতে। জল খেতে চাইলে রোগীকে জল দেওয়া যাবে। নজর রাখতে হবে, রোগীর মনোবল যাতে ভেঙে না পড়ে। সর্পদংশনের জায়গাটা কেটে দেওয়া, বেঁধে দেওয়া বা বরফ দেওয়া— ঠিক নয়। সাপের কামড়ের দশ মিনিটের মধ্যে উপসর্গ দেখা না গেলে বুঝতে হবে নির্বিষ সাপে কামড়েছে। বিষ কখনওই ‘নামে’ না। ক্ষতস্থান থেকে থকথকে হলুদাভ তরলটিকে বের করে আনা অসম্ভব। বিষ নামানো শিকড়, ধাতু, বিষঝাড়া পাথর, মন্ত্রপূত থালা, সব লোক ঠকানো কৌশল।

অমলকান্তি পাণ্ডে মেদিনীপুর

দু’রকমই ছিল

জয়ন্ত ঘোষালের ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ (১২-৭) পড়লাম। আমি এক সময় উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় গঙ্গার কূলে যে অঞ্চলে থাকতাম, সেটি সংস্কৃতচর্চার পীঠস্থান। এই জায়গাকে কেউ কেউ বাংলার অক্সফোর্ড বলতেন। সেখানে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ভেতর প্রায় ষোলো আনা না হলেও অন্তত পক্ষে বারো আনা ব্রাহ্মণ পরিবার। ওই এলাকায় পুরনো বাসিন্দা বলতে ওই ‘বামুন’দেরই বোঝায়। সেখানে পাড়াগুলির নামেও বেশ বৈচিত্র। ‘চালাকি পাড়া’, ‘বাবু পাড়া’, ‘সদগোপ পাড়া’, ‘মুখার্জী পাড়া’, ‘ঘটক পাড়া’ ইত্যাদি। আমার পৈতৃক বাড়ি ঠাকুরপাড়ায়। অনেকেই যাকে ‘গোঁড়া বামুন পাড়া’ বলেই চেনেন। সেখানে অধিকাংশ বাড়িতে নানা দেবদেবীর পুজোআচ্চা লেগেই থাকত। এমন অনেককেই জানি, যাঁরা সেই সময় গঙ্গাজল ছাড়া অন্য কোনও জল খেতেন না। আমার ঠাকুমাও সে দলে ছিলেন। এক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ, যাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান, তিনি ওই এলাকার পুরনো বামুন বাড়ির সন্তান। গঙ্গাজল পাবেন না বলে কখনও দেশের বাইরে যাননি।

আমার ঠাকুমা তখন বেঁচে। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়। হঠাৎ করে শুনলাম দু’জন গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়িতে কিছু দিনের জন্য থাকবেন। বাংলাদেশ রাইফেলস-এর আনোয়ার হুসেন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া পিয়ার আলী। কল্যাণীর নেহরু হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন আমাদের বাড়ি তাঁদের আশ্রয়স্থল। অল্প কিছু দিনের ভেতর আনোয়ারদা ও পিয়ারদাকে নিয়ে আমরা ছোটরা মেতে উঠলাম। সুযোগ পেলেই যুদ্ধের গল্প শুনতাম। আমার যে ঠাকুমা পেঁয়াজের খোসা ধারেকাছে ঘেঁষলে খাবার টান মেরে ফেলে দিতেন, তিনিও আনোয়ারদা ও পিয়ারদার সঙ্গে একই ছাদের তলায়! প্রথমে না জানালেও পরে গঙ্গার ঘাটের আড্ডা থেকে ঠাকুমা আনোয়ারদা ও পিয়ারদার আসল পরিচয় জেনে যান। কিন্তু তার জন্য কখনওই বাড়ি মাথায় করেননি কিংবা বামুন বাড়ির আতিথেয়তা একটুও ঢিলে হয়নি। ওই মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ফিরে যান।

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে দুটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার উল্লেখ করছি। কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন তাঁর ‘সেদিনের কথা’তে লিখেছেন, উনি ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় ফার্ন রোডে থাকতেন, এক দিন দেখেন ট্রাম লাইনের ধার দিয়ে লুঙ্গি পরা এক জন ছুটছে, তাকে তাড়া করেছে ওই অঞ্চলের কিছু বাসিন্দা। বাড়ির বারান্দা থেকে বাড়ির মেয়ে-বউরা লাঠি শাবল যে যা পারছে পুরুষদের এগিয়ে দিচ্ছে। ওঁর লেখাতেই পাই বালিগঞ্জ স্টেশনের লাগোয়া রাস্তায় ছেলেদের মেসে ডাক্তারি পড়ুয়া থাকত। ওই দাঙ্গার সময় এক দিন দেখেন, সেই ছাত্ররা এক দিন আনা দিন খাওয়া বৃদ্ধ মুসলমানকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিল।

বরুণ ভট্টাচার্য কলকাতা-৩৯

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE