Advertisement
২০ মে ২০২৪
Coronavirus

ধর্ম নয়, পরিত্রাতা বিজ্ঞানই, যেন ভুলে না যাই অবস্থা স্বাভাবিক হলে

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।সে দিন যেন ভুলে না যাই এই বিপদের আসল ত্রাতা ধর্ম নয়, বিজ্ঞান। হিংসা নয়, মনুষ‍্যত্ব। ক্ষমতার অলিন্দে বসে থাকা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ নয়, রাতদিন এক করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যাঁরা আমাদের বাঁচানোর কাজ করে চলেছেন, তাঁরাই।

এখন নিউ জার্সি।

এখন নিউ জার্সি।

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২০ ১৬:০৮
Share: Save:

চার মাসের বরফশীতল দিনগুলো কেটে গিয়ে বসন্ত এসে গিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম বসন্ত এল শীতের রিক্ততা আর নৈঃশব্দ নিয়ে।

আমরা নিউ জার্সির একটি মফস্‌সলে থাকি। নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে মাইল পনেরো দুরে, অফিস ওয়াল স্ট্রিট থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে। যে দিন নিউ ইয়র্কে প্রথম করোনা পজিটিভের সংখ‍্যা ছিল এক, সে দিনটা আজ থেকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে। সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত কী ভাবে এই মারণ রোগের করাল থাবা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল এলাকাকে এমন স্তব্ধ করে দিল, তা ভাবলেও শিউরে উঠি।

মার্চ ১, ২০২০

৬ ঘণ্টা দূরে ভার্জিনিয়ায় ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় বন্ধুর মেসেজ পেলাম। ‘‘আমাদের এলাকায় হ‍্যান্ড স‍্যানিটাইজার বা সাবান কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।’’ ফলে, একটি প্রত‍্যন্ত এলাকায় ওয়াল মার্টের একটি সুপার সেন্টার থেকে নিজের ও অন্যদের জন‍্য তা নিয়ে নিলাম।

সে দিন আক্রান্তের সংখ‍্যা নিউইয়র্ক স্টেটে ছিল ৬। সিটিতে এক জন। আর নিউ জার্সিতে সে দিন পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায়নি।

মার্চ ৪, ২০২০

আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে নিউইয়র্ক স্টেটে হল ১০৬। সিটিতে ১৩। আর নিউ জার্সিতে ৬।

বুঝতে পারছি সামনে কঠিন সময় আসতে চলেছে। নিউইয়র্কে ‘স্টেট অফ এমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা হয়েছে। চার পাশে অধিকাংশ মানুষ তখনও ভাবলেশহীন। শহরে স্কুল, কলেজ, অফিস-কাছারি, পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন পুরোদমে চালু।

মার্চ ১৫, ২০২০

আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে নিউইয়র্ক স্টেটে হল ৭৯২। সিটিতে ৩২৯। আর নিউ জার্সিতে ৬৯।

তখন স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়েছে। অনলাইনে ক্লাস চলছে। অফিসগুলোতে তখনও ওয়ার্ক ফ্রম হোম ‘স্ট্রংলি সাজেস্টেড’। কিন্তু ‘ম‍্যান্ডেটরি’ নয়। লোকজন প্রাণ হাতে নিয়ে শহরে কাজ করতে যাচ্ছেন।

‘গ্রসারি স্টোরে’র ‘আইল’গুলো সব ফাঁকা। বেশ কিছু লোক তবু অসচেতন। বিচ বা পার্কে যাওয়া এমনকী, ‘করোনা পার্টি’তে দু’শো লোকের জমায়েতের কথাও কানে আসছে।

মার্চ ২২, ২০২০

আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে নিউইয়র্ক স্টেটে হল ২১ হাজার। সিটিতে ১২ হাজার। আর নিউ জার্সিতে এক হাজার ৯০০।

নিউইয়র্ক ‘লক্ড ডাউন’ হল। আমরা ঘরবন্দি হলাম। মল, থিয়েটার, জিম সব বন্ধ। নন-এমার্জেন্সি ডক্টরস’ ভিজিট বা হবি ক্লাস, সবই হচ্ছে অনলাইনে। চার দিকে মৃত‍্যুর মিছিল। হাসপাতালগুলোতে পিপিই আর ভেন্টিলেটরের অভাব। নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন‍্য প্রায় এক মাইল লম্বা লাইন।

মার্চ ৩০, ২০২০

আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে নিউইয়র্ক স্টেটে হল সাড়ে ৬৬ হাজার। সিটিতে ৩৮ হাজার। আর নিউ জার্সিতে ১৬ হাজার।

মনে পড়ে যাচ্ছে, বহু বছর আগে দেখা ডাস্টিন হফম‍্যানের ‘আউটব্রেক’ মুভির কথা। জীবদ্দশায় এমন দিন দেখতে হবে ভাবিনি! ‘আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট ক্লেম’ আর্থিক মন্দার সময়ের রেকর্ডও ছাপিয়ে গিয়েছে। ‘আনডকুমেন্টেড’ দিন আনি দিন খাই অভিবাসী মানুষগুলোর দিন কী ভাবে চলছে, জানি না।

এপ্রিল ৬, ২০২০

আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে নিউইয়র্ক স্টেটে হল এক লক্ষ ৩০ হাজার। সিটিতে ৬৮ হাজার। আর নিউ জার্সিতে ৪১ হাজার।

অপেক্ষায় আছি, কবে কাটবে এই অদ্ভুত আঁধার! ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি দেশে থাকা পরিবার, প্রিয়জন আর সাধারণ মানুষের দুরাবস্থার কথা ভেবে। নিম্নমধ‍্যবিত্ত পরিবার ও পরিপার্শ্বে বড় হয়েছি বলে জানি মাথার উপর ছাদ, চাকরি আর মাসাধিকের মজুত খাবার নিয়ে ঘরে থাকতে পারাটা খুব ভাল থাকা। কিন্তু বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছি মানুষের অসচেতনতা আর অতিমারির সময়েও অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত হুজুগ নিয়ে। আতঙ্কে আছি আসন্ন আর্থিক মন্দা নিয়ে। এ দেশে ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার প্রত‍্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, করোনা-যুদ্ধে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মানুষের উপর যদি আর্থিক মন্দার আঘাত আসে, তার চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছুই হতে পারে না।

যাই হোক, শুধুই হতাশার কথা নয়, কারণ সূর্যোদয় এক দিন হবেই ক্লেদহীন পৃথিবীতে। প্রকৃতি তখন আরও সুস্থ, আকাশ অনেক বেশি স্বচ্ছ, বাতাস অনেক নির্মল। সে দিন যেন ভুলে না যাই এই বিপদের আসল ত্রাতা ধর্ম নয়, বিজ্ঞান। হিংসা নয়, মনুষ‍্যত্ব। ক্ষমতার অলিন্দে বসে থাকা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ নয়, রাতদিন এক করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যাঁরা আমাদের বাঁচানোর কাজ করে চলেছেন, তাঁরাই।

সুপর্ণা দাস, নিউ ইয়র্ক/নিউ জার্সি, আমেরিকা।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE