স্বর্ণজয়ী: নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথ গেমসের পদক নিয়ে (বাঁ দিক থেকে) জেরেমি লালরিন্নুঙ্গা, দীপক পুনিয়া এবং অচিন্ত্য শিউলি
সদ্যসমাপ্ত বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে ভারত একটা বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে ক্রীড়াবিশ্বের কাছে— এই নতুন ভারত শুধু যোগ দিতে নয়, শাসন করতেও এসেছে। যে কথা ভারোত্তোলনে সোনা জিতে প্রমাণ করে দিয়েছেন মীরাবাই চানু, অচিন্ত্য শিউলিরা। অজানা-অচেনা কয়েকটি মেয়ের হাত ধরে সোনা এসেছে লন বোলসের মতো খেলাতেও। আর ব্যাডমিন্টনের রানি পি ভি সিন্ধু দেখিয়ে দিয়েছেন, কেন তাঁর মাথাতেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা শোভা পায়।
চার বছর আগের কমনওয়েলথ গেমসে ভারত ৬৬টা পদক জিতেছিল, এ বার ৬১টা। এ বার সোনা এসেছে ২২টি, গত বার ছিল ২৬। কিন্তু পদকসংখ্যা কখনওই এ বার সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, গত বার শুটিংয়ের মতো ইভেন্ট ছিল কমনওয়েলথে। যেখানে ১৬টি পদক জিতেছিলেন ভারতীয় শুটাররা। সাতটি সোনা এসেছিল শুটিংয়েই! এ বার আর শুটিং অন্তর্ভুক্ত হয়নি গেমসে। যে কারণে অনেকে মনে করেছিলেন, ৫০টি পদক পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। তার উপরে শেষ মুহূর্তে নীরজ চোপড়ার সরে দাঁড়ানোটা বড় ধাক্কা ছিল ভারতের কাছে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ৬১টা পদক এবং চতুর্থ স্থান দখল করে গেমস শেষ করেছে ভারত। শুটিং থাকলে পদকসংখ্যা অনেক বেশি হত নিঃসন্দেহে।
সবচেয়ে বেশি পদক এসেছে কুস্তিতে। ১২টি। এর পরে ১০টি পদক জিতেছেন ভারোত্তোলকরা। চারটি খেলায় সেরা ফল করেছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা। কুস্তি (৬টি সোনা), টেবল টেনিস (৪টি সোনা), ভারোত্তোলন (৩টি সোনা), এবং ব্যাডমিন্টন (৩টি সোনা)।
তবে চমকে দিয়েছেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যাথলিটরা। তিন হাজার মিটার স্টিপলচেজ়ে কেনিয়ার আধিপত্য ভেঙে রুপো জিতেছেন অবিনাশ সাবলে। মেয়েদের ১০ হাজার মিটারে রুপো পেয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গোস্বামী। তবে সব সেরা এলঢোস পল। ট্রিপল জাম্পে সোনা পেয়েছেন তিনি, আবদুল্লা আবুবাকের পেয়েছেন রুপো। গত বারের চেয়ে এ বারে পাঁচটি বেশি পদক এসেছে অ্যাথলেটিক্সে, এ খুব কম কথা নয়।
প্রাঞ্জল দাস, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
লক্ষ্যপূরণ সিন্ধুর
২০১৪ সালের কমনওয়েলথ গেমস-এ এসেছিল ব্রোঞ্জ। সে বছরই এশিয়ান গেমসেও পি ভি সিন্ধু জয় করেন ব্রোঞ্জ। যদিও ২০১৬-র অলিম্পিক্সে রুপো জিতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৮-র কমনওয়েলথ গেমসেও সোনা থাকে অধরা। মেলে ব্রোঞ্জ। ওই একই বছর এশিয়ান গেমসে রুপো জেতেন তিনি। ২০২১-এর অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ-এই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে। বার বার তীরের কাছে এসে তরী ডুবলেও হাল ছাড়েননি সিন্ধু। এ বারের কমনওয়েলথ গেমস-এ ব্যাডমিন্টন সিঙ্গলস ফাইনালে কানাডার মিশেল লি-কে হারিয়ে কাঙ্ক্ষিত সোনা জয় করেই ছাড়লেন তিনি।
অর্পণ ঘোষ, মসিনান, হুগলি
সফল মীরারা
কমনওয়েলথ গেমসে নয়া নজির সৃষ্টি করলেন মীরাবাই চানু। ভারোত্তোলনের স্ন্যাচ ও ক্লিন এবং জার্ক বিভাগে মোট ২০১ কিলোগ্রাম তুলে প্রতিযোগিতায় নতুন রেকর্ড গড়লেন তিনি। প্রসঙ্গত, ২০১৮-য় গোল্ড কোস্টে সোনা আর তার চার বছর আগে গ্লাসগোয় রুপো পান চানু। ২০১৮-র কমনওয়েলথ গেমসেও ভারোত্তোলনে দুরন্ত সাফল্য পেয়েছিল ভারত। এ বারও ভারতের ভারোত্তোলকরা পদক জয়ের ধারা অব্যাহত রাখলেন।
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি
মেয়েদের জয়
আজ যখন অলিম্পিক্স ও প্যারা অলিম্পিক্সে মীরাবাই চানু, লাভলিনা বরগোঁহাই, পি ভি সিন্ধু, ভাবনা, অবনী লেখারা দেশের হয়ে পদক জিতে দেশকে গর্বিত করছেন, তখন আমরা তাঁদের নিয়ে হইচই করছি। না হলে এ দেশে মহিলা খেলোয়াড়দের কদর ছিল কতটুকু? কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমরা তাঁদের খোঁজখবর রাখা তো দূরের কথা, নামটা পর্যন্ত জানতাম না। এ দেশে মহিলা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলে এই সমাজে তাঁদের কোনও মূল্য নেই।
ভারতের মতো দেশে আজও শুধু ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, যে কোনও ক্ষেত্রে মেয়েদের নিজস্ব পরিচিতি গড়া কঠিন কাজ। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে অন্যতম বড় বাধা পুরুষতন্ত্র। আর খেলার জগতে মহিলাদের প্রতিষ্ঠা অর্জন? অলিম্পিক্স বা সমপর্যায়ের প্রতিযোগিতায় গলায় মেডেল ঝোলাতে না পারলে একটি মেয়ে ‘সাধারণ মেয়ে’ হয়েই রয়ে যান, সমাজে ‘খেলোয়াড়’ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন না। এমনকি যে ক্রিকেটকে নিয়ে এ দেশে এত মাতামাতি, এত টাকার লেনদেন, সেই ক্রিকেটেও সামান্য আইপিএল খেলা পুরুষ খেলোয়াড়ের পরিচিতি ও উপার্জনের ধারেকাছে কোনও মহিলা ক্রিকেটার নেই। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কুড়ি বছরের বেশি ক্রিকেট খেলা হয়ে গিয়েছে দুই বিশ্ব রেকর্ডধারী ভারত তনয়া মিতালি রাজ ও ঝুলন গোস্বামীর। মিতালি যদিও এখন খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ, হালে মানুষ তাঁদের নাম জেনেছেন। এ ছাড়া বর্তমানের মহিলা ক্রিকেট দলের নামী উঠতি খেলোয়াড় স্মৃতি মান্ধানা, হরমনপ্রীত কাউর, শেফালি, দীপ্তিদেরই বা আগে ক’জন চিনতেন? অথচ, পুরুষ খেলোয়াড়দের মতোই এঁরাও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন।
আসলে, একটি মেয়েকে মেয়ে থেকে খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পুরুষতন্ত্রের যে বাধা অতিক্রম করতে হয়, তার শুরুটা তো হয় নিজের বাড়ি থেকেই। আজও গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ বাড়িতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কম খাদ্য জোটে— পরিমাণ ও পুষ্টির দিক থেকে! আজও ক’জন বাবা-মা বা অভিভাবক চান যে তাঁদের মেয়ে খেলোয়াড় হোক? মেয়ে পড়াশোনা শিখবে, বিয়ে করে সংসার করবে— এই গতানুগতিক ভাবনার বাইরে অনেকেই বেরোতে পারেননি। অথচ, হাতের কাছেই রয়েছে জ্বলন্ত উদাহরণ— মীরাবাই চানু, পি ভি সিন্ধু, লাভলিনা বরগোঁহাই, হিমা দাস, ঝুলন গোস্বামীরা। এ ছাড়া কোনিদের জন্য এ পোড়া দেশে ক্ষিদ্দাদের মতো ক’জন পাগলেরই বা দেখা মিলবে? তাই আজও এ দেশে মেয়েদের জীবনে প্রদীপের নীচের অন্ধকার থেকেই গিয়েছে।
যদিও খেলাধুলায় এখন আগের চেয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এমনকি প্রতিবন্ধী মেয়েদের ক্ষেত্রেও। গত বারের প্যারা অলিম্পিক্সে দীপা মালিক এবং এ বারের প্যারা অলিম্পিক্সের আসরে অবনী, ভাবনারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। বর্তমানে মহিলা ক্রিকেট দলকে আগের মতো স্টেডিয়ামের নোংরা ঘরের মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে রাত কাটাতে হয় না। তাঁদের রাখা হয় পাঁচতারা হোটেলে। তবে, খেলার অন্যান্য ক্ষেত্রে মহিলারা এখনও এই সুবিধা পান না। অবশ্য, তাতে তাঁদের আটকে রাখা যাবে না। তাঁরা তাঁদের শ্রম, নিষ্ঠা, জেদ এবং নৈপুণ্যে নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তুলবেন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা আদায় করেই ছাড়বেন।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
সেরা অচিন্ত্য
বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত এ বছরের কমনওয়েলথ গেমস-এ পুরুষদের ৭৩ কিলোগ্রাম ব্যক্তিগত বিভাগে মোট ৩১৩ কিলোগ্রাম ওজন তুলে সোনা জয় করলেন দেউলপুরের অচিন্ত্য শিউলি। এই বিশ্বজয়ের পিছনে যাঁর অবদান কম নয়, তিনি হলেন প্রশিক্ষক অষ্টম দাস। অষ্টম দাস নিজে কৃষকের কাজ করেও অবসর সময়ে প্রতিনিয়ত অনুশীলন করাতেন বিনা পারিশ্রমিকে। অচিন্ত্য শিউলির ঝুলিতে আরও পদক আসুক, বাংলার মুখ উজ্জ্বল হোক, এই কামনা রইল।
শ্রীমন্ত পাঁজা, গঙ্গাধরপুর, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy