Advertisement
০২ মে ২০২৪
Poverty of India

সম্পাদক সমীপেষু: অভাব ও আতিশয্য

লেখক আবেদন করেছেন, যাতে আমরা বাস্তব অবস্থা চিনে নিতে পারি। কিন্তু বাস্তব-অবাস্তব গুলিয়ে দিচ্ছে শাসক।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:২৬
Share: Save:

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ‘কোন ছবি যে দেখব কখন’ (১২-৯) প্রবন্ধে দেশের বর্তমান নেতাদের ঢক্কানিনাদের পাশে সতত-নীরব, দুঃখী ভারতের ছবির কথা অকপটে বলেছেন। দেশের রাষ্ট্রবাদী রাশভারী নেতাদের মুখনিঃসৃত বাণীর মধ্যে লুকিয়ে থাকে জাদুবাস্তবতা। তার শর্ত আতিশয্য, কল্পনার অবাধ উড়ান। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে আতিশয্যের ছড়াছড়ি। আমাদের দেশের বর্তমান নেতারা নিজেদের সাফল্য বাড়িয়ে প্রচার করেন। জনসাধারণ তাতে বুঝতে পারে না যে, ভারত এখনও একটি দরিদ্র দেশ। গ্রামের দরিদ্র মানুষ ভিখারি হতে শহরে চলে আসছে। ভারত এক ‘মাকন্দো’, যে কাল্পনিক স্থানের পটভূমিতে মার্কেস তাঁর বিশ্বজয়ী উপন্যাস নির্মাণ করেছেন। ভারত যে তার গর্বের আসন হারাতে চলেছে তার প্রমাণ সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।

লেখক আবেদন করেছেন, যাতে আমরা বাস্তব অবস্থা চিনে নিতে পারি। কিন্তু বাস্তব-অবাস্তব গুলিয়ে দিচ্ছে শাসক। ডিজিটাল চকমকির অন্তরালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ছেঁড়া ত্রিপল-চাপা বস্তি-ভারত। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে পাখির ডাক শুনে বিদেশিরা চিনতে পেরেছিল মাকন্দোকে। ভারতের আমন্ত্রিত অতিথিরা দিল্লির সাজগোজ থেকে হয়তো এক প্রতাপশালী দেশকে চিনলেন। পুরনো ত্রিপল-ঢাকা বস্তিগুলো ওঁরা দেখতে পাননি। দেখেননি শিক্ষাহীন, কর্মহীন লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীকে, দাঙ্গাবিধ্বস্ত মণিপুর কিংবা নুহ, বা কতিপয় পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ ধনরাশি। প্রশ্ন করেননি, এত গরিব লোক রাস্তায় বা ঝুপড়িতে থাকে কেন? এ প্রশ্ন করা যায় না, প্রোটোকলে বাধে।

আত্মম্ভরি রাষ্ট্রনেতা মনের মতো জাদুবাস্তবতা নির্মাণ করেন; তাঁর ভারত দ্রুত বিকাশের পথে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে, বিশ্বকে সত্যের পথ দেখাবে। আকাশে ওড়ে যুদ্ধ-বিমান, সমুদ্রে ভাসে যুদ্ধজাহাজ, আসবে বুলেট ট্রেন, আসবে নতুন ডিজিটাল কলা-কৈবল্য। কিন্তু তিনি বলেন না যে, এক দল ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠছে আর দারিদ্র-সীমার অঙ্ক নিয়ে বিতর্ক চলছে সংসদে। ভারতের দারিদ্র চাপা দিতে শাসক অতি তৎপর। বর্তমান ভারত বা ‘ইন্ডিয়া’র শাসকদের আস্ফালন দেখে শ্লেষের কথাই মনে আসে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমণ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আত্মপ্রচার ছাড়া কী করেন? বিদেশের শিক্ষিত মানুষ জানেন যে, ভারতে মেধার অভাব নেই। কিন্তু শোষণের নিরিখে অনেক দেশের উপরে তার স্থান। উপরমহলে দুর্নীতি, অপশাসন এবং কতিপয় শিল্পপতিকে সুবিধা প্রদান আমাদের দেশকে ক্রমে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

তরুণ কুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫

পিলসুজ

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এ দেশের বিবেকবান মানুষকে একাধিক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন— জি২০ গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলি পালা করে গোষ্ঠীপতির আসন পায়, আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ কোনও কৃতিত্ব না থাকলেও, সেই সম্মেলনকে কেন্দ্রে রেখে ৪১০০ কোটি টাকার এক মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হল। শুরুতেই বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল গরিব মানুষের একাধিক বস্তি। কম দামি কালো প্লাস্টিক বা ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে জীবন-সম্ভ্রম রক্ষার একমাত্র আশ্রয়স্থল এই বস্তিগুলোই। সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত কুলি-মজুরদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই। বস্তির এমন হতশ্রী চেহারার ‘ছবি’ কী ভাবে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের দৃষ্টির নাগালে রাখা সম্ভব? সুতরাং, বস্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দাও, অথবা কাপড় বা প্লাস্টিকের আড়ালে ঢেকে দাও। রাজাগজাদের ভোজসভার মহামূল্যবান রুপোর থালা-বাটি-গেলাসের ছবির পাশাপাশি এমন ছবি যে নিতান্তই বেমানান।

বছর কয়েক আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন এ দেশে এসেছিলেন, তখনও বস্তিবাসীদের কপালে এমনই দুর্ভোগ জুটেছিল। অসুন্দর বস্তিগুলিকে মেনে নেওয়া ইটালিয়ান স্যুট, আমেরিকান বুট পরিহিত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সত্যিই কঠিন। লেখক ঠিকই বলেছেন, “উন্নয়নের ঠেলায় স্বভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে কিংবা অন্নহীন কর্মহীন স্বভূমি ছেড়ে বাঁচার তাগিদে শহরে এসে ঠাঁই নেওয়া মানুষের ছেঁড়াখোঁড়া বসতিতে টিকে থাকা জীবন।” বস্তিবাসীদের কাছে ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ কি শুধু কথার কথাই থেকে যাবে? প্রতিটি শহর ও শহরতলির ফাঁকে ফাঁকে, রেল লাইনের দু’ধারে এমন বহু কুদর্শন বস্তির দেখা মিলবে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব চলাকালীন এ দেশের একটা বৃহৎ সংখ্যক মানুষ কেন বস্তিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন? এমন অপ্রিয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বর্তমান শাসকেরা কোনও দিন চাননি, ভবিষ্যতেও চাইবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

বস্তিবাসীদের জীবন সংগ্রামের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, এমন ব্যক্তিদের অনেকেই এই মানুষগুলোকে সভ্যতার পিলসুজ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের দাবি, এখানেই বসবাস করেন কোটি কোটি বিশ্বকর্মা। বহুতলের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত দক্ষ রাজমিস্ত্রি, ঠিকা শ্রমিক, ভারী মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজের পরিশ্রমী মজুর থেকে শুরু করে গৃহসহায়িকার কাজে নিযুক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন শহরের ঝলমলে জনজীবনকে সচল রাখতে। তাই অর্থনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্রের আলোচনায় বস্তিবাসীদের জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত বারে বারে উঠে আসে। একে অস্বীকার করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা অবান্তর।

ভারত সরকার দেশের গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ এই জি২০ সম্মেলন উপলক্ষে খরচ করল, তাতে শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভারতবাসী কতটা উপকৃত হলেন, এমন অপ্রিয় প্রশ্ন আড়ালেই থেকে যাবে। যেমন আড়ালে থেকে যাবে, সম্মেলনে উপস্থিত রাষ্ট্রনায়কেরা নিজের দেশের জন্য কে কতটা সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। আর কেনই বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা কিংবা ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করার কোনও উদ্যোগ এই সম্মেলনে করা গেল না?

রতন রায়চৌধুরী কলকাতা-১১৪

শাসকের চোখে

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটির মধ্যে যে দুটো বিপরীত মেরুর ছবি ফুটে উঠেছে, তা যথাযথ। ভারতের সভাপতিত্বে দু’দিনের জি২০ সম্মেলন হয়ে গেল রাজধানী দিল্লিতে। ভারতমণ্ডপম্-এ সম্মেলনের প্রতিনিধিদের জন্য দেওয়া নৈশভোজ রুপোর থালা-গেলাসে পরিবেশিত হলেও, সম্মেলন স্থলের আশপাশে বস্তিবাসীদের মাথা গোঁজার ঝুপড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে ‘সাফসুতরো’ করা হল। এই চেষ্টা একটি নির্মম সত্যকে আড়াল করা ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তি-ঝুপড়ি কোন দেশে নেই? তা বাড়তে দেওয়া বা গজিয়ে ওঠার পিছনে প্রশাসনিক উদাসীনতাই কাজ করে বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে আগতদের ভোট পাওয়ার লোভে বস্তির অস্থায়ী ঠিকানায় রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড পাইয়ে দেওয়ার সময়ে প্রশাসন খোঁজ রাখে না কী করছি, কাদের জন্য করছি। দেশ এগিয়ে চলেছে— এ বিজ্ঞাপন দেখে ও শুনে দিন কাটলেও কেন যে অগণন মানুষকে জমি জবরদখল করে বাস করতে হয়, বা ফুটপাতের এক কোণে ত্রিপল টাঙাতে হয়, বোঝা যায় না। ক্ষমতার অলিন্দে যাঁরা, তাঁরা আমাদের দৃষ্টি ও বোধকে তাঁদের নিজেদের মতো করে গড়ে তোলেন। তাঁদের চোখ দিয়ে দেশ চিনছি, শহরকে জানছি, প্রশাসন কী, তা-ও বুঝছি। তাই সম্মাননীয় বিদেশি অতিথিদের চোখের আড়ালে নিজেদের জীর্ণ বসন বা বাসস্থান রঙিন পর্দায় ঢাকা পড়ুক, তাতে দেশের সম্মান তো বাঁচল। বাস্তবকে ঢেকে বা মুছে দিয়ে কত দিন নকল জামায় সেজে বর্তমানকে তুলে ধরব, আর উন্নয়নের গান গাইব?

সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা কলকাতা-১৫৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poverty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE