বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের কথা বহুলপরিচিত। অধিকাংশ বহুলপরিচিত কথার মতোই ইহাও সচরাচর কথার কথামাত্র— বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করিতে চাহিলে প্রায়শই ভুল হয়, অনেক সময় মর্মান্তিক ভুল। সিন্ধু দেখিতে চাহিলে সিন্ধু দেখাই শ্রেয়। কিন্তু বিন্দুতে বিন্দু দর্শন সম্ভব, এবং দর্শনটি যথাযথ হইলে তাহা উপকারীও বটে। কেরলের স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচনী ফলাফলকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করা বিধেয়। পঞ্চায়েত ও পুরসভা মিলাইয়া বিভিন্ন স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থার ৩৯টি আসনে উপনির্বাচনে ২১টিতে জয়ী হইয়াছে রাজ্য সরকারের গদিতে আসীন সিপিআইএম চালিত বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা (এলডিএফ)। প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চার (ইউডিএফ) ঝুলিতে ১১টি। আপাতবিচারে পঞ্চায়েত বা পুরসভার উপনির্বাচন তুচ্ছ ব্যাপার বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু এই ফল একাধিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, উপনির্বাচন হইয়াছে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়িয়া, অর্থাৎ একটি নহে, অনেকগুলি বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের সুযোগ মিলিয়াছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রম লইয়া রাজনীতি বারংবার উত্তাল হইয়াছে, এলডিএফের অন্তর্দ্বন্দ্বও রীতিমত প্রকট। সেই সমস্যা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী সাফল্যের গুরুত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সিন্ধু না হউক, তাহার একটি বড় অংশের বাস্তব দিব্য দেখা যাইতেছে।
সাম্প্রতিক আলোড়নের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিন্দুর মাহাত্ম্য কম নহে। সেই বিন্দুর নাম শবরীমালা। সেই পাহাড়ে আয়াপ্পার মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশাধিকার লইয়া ধুন্ধুমার চলিয়াছে সাম্প্রতিক কালে, এখনও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলা চলিবে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানিয়া এলডিএফ সরকার কার্যত একক ভাবে মহিলাদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে দাঁড়াইয়াছে। বিরোধীরা ঘোলা জলে মাছ ধরিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়া আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে ‘আন্দোলন’ করিয়াছে। এই অগণতান্ত্রিক পশ্চাদ্মুখী জঙ্গিয়ানার পক্ষে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থান কেবল প্রকট নহে, অতিমাত্রায় দৃষ্টিকটু। কংগ্রেস তাহার বহুচর্চিত সুবিধাবাদী অবস্থানে দাঁড়াইয়া পায়ে পা ঘষিয়াছে। রাজ্যের নাগরিক সমাজেও শবরীমালার ‘ঐতিহ্য’ রক্ষার নামে মেয়েদের পথ রোধের পক্ষে জনমত সরব ও সক্রিয়। স্বভাবতই, সংশয় ছিল, এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতে গিয়া বামপন্থী সরকার জনসাধারণের বিরাগভাজন হইবে। কিন্তু, অন্তত উপনির্বাচনী লক্ষণ বলিতেছে, তাহা ঘটে নাই। সামগ্রিক ভাবে এলডিএফ সফল। সর্বোপরি, শবরীমালা যে পুর এলাকায়, সেখানেও বিজেপি পরাজিত। ধর্মের নাম ভাঙাইয়া রাজনীতির দুরভিসন্ধি পরাজিত। দুই নৌকায় পা রাখিয়া এবং নরম হিন্দুত্বের প্রতি ঝুঁকিয়া কংগ্রেস ভোটের মার খাইয়াছে, ইহাও কম তাৎপর্যপূর্ণ নহে। কেরলের নাগরিকরা সম্ভবত বলিতে চাহিয়াছেন, জীবন ও জীবিকা তাঁহাদের নিকট অনেক বেশি মূল্যবান। এবং সেই মূল্যবান প্রশ্নে রাজ্য সরকারকে তাঁহারা ভাল নম্বর দিতে চাহেন। তাহার কারণও আছে। এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অভিঘাতে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা বিপন্ন হইয়াছে মাত্র কয়েক মাস আগে। কিন্তু রাজ্য সেই অভিঘাত দ্রুত সামলাইয়া উঠিয়াছে এবং তাহা ঘটিয়াছে রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে। স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল দৃশ্যত সেই কৃতির সুফল ফলিবার সুলক্ষণ। নাগরিকদের কাণ্ডজ্ঞানেরও। তাহার অন্য লক্ষণও মিলিয়াছে— সম্প্রতি দিল্লির কৃষক সমাবেশ হইতে দাবি উঠিয়াছে: রামমন্দিরের আগে রুটি চাই। দেশের দুই প্রান্তে দুই বিন্দু মিলাইয়া সিন্ধুদর্শন করিতে গেলে ভুল হইতে পারে। তবু, নরেন্দ্র মোদীদের ভারতে এই কাণ্ডজ্ঞানই আপাতত সাধারণ মানুষের ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy