বহু-বিজ্ঞাপিত উদ্বোধনের দু’দিন পর বন্দে ভারত-এর গায়ে ঢিল ছুড়তে আবার মঞ্চে উঠলেন রাজনীতিকরা। ফাইল ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে ‘বন্দে ভারত’-এর নাম বদলে ‘বন্দে বিতর্ক’ করে দেওয়া উচিত। প্রথম থেকেই বিভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে (যেমন— ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান এবং তাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ) এই ট্রেন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। অথচ, চোখ ছানাবড়া করে দেওয়ার মতো কোনও বৈশিষ্ট্য এই গাড়ির নেই। এর আগে ছুটেছে গতিমান রাজধানী, শতাব্দী, দুরন্ত। নতুনরা আসবে, পুরনোরা বিদায় নেবে— এটাই জগতের নিয়ম। কোনও নতুন ট্রেনের যাত্রার সূচনা নিয়ে সমাজমাধ্যমে এত উন্মাদনা, এত রাজনৈতিক উত্তেজনা আগে দেখা যায়নি।
বহু-বিজ্ঞাপিত উদ্বোধনের দু’দিন পর বন্দে ভারত-এর গায়ে ঢিল ছুড়তে আবার মঞ্চে উঠলেন রাজনীতিকরা। কেউ বললেন এটা রাজ্যের চক্রান্ত— ‘জয় শ্রীরাম’-এর বদলা। কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, এর পর রাজ্য আর বন্দে ভারত পাবে না! কেউ অনুমান করলেন, বিজেপিই ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে! কেউ দাবি করলেন এনআইএ তদন্তের। অথচ, কেউ ভেবে দেখলেন না যে, চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোড়া এ দেশে একটা খেলা। শয়ে শয়ে এই ঘটনা প্রত্যেক বছর ঘটে চলেছে। পাথর লেগে ট্রেনযাত্রীর দৃষ্টি হারানোর মতো ঘটনা এ রাজ্যেই ঘটেছে। অন্য দু’টি বন্দে ভারতও ঢিল ছোড়ার আঘাতের ‘সৌভাগ্য’ থেকে বঞ্চিত হয়নি।
অবশ্যই এই খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, অপরাধীরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। কোনও রাগের বহিঃপ্রকাশে, বা কোনও আন্দোলনের সমর্থনে নয়, পথচলতি কুকুরের মতোই, চকচকে নতুন ট্রেনও তাদের কাছে একটা সহজ চাঁদমারি। শুধু আইন প্রয়োগ নয়, তাদের বোঝানোটাও দরকার। তার জন্য রেল বোর্ড চেষ্টাও চালাচ্ছে।
একই রকম ভাবে, বন্ধ হওয়া দরকার এই ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতি। রেললাইনের ধারে ঝুপড়িতে বাস করা ওই গরিব ছেলেগুলোর সঙ্গে এই রাজ্যের জ়েড ক্যাটেগরি নিরাপত্তা নিয়ে, টিভি চ্যানেলকে বাইট দিয়ে বেড়ানো রাজনীতিকদের বুদ্ধ্যঙ্কের খুব একটা পার্থক্য বোধ হয় নেই। না হলে তাঁদের এক জন বলতে পারতেন না যে— দেশের গর্ব এই ট্রেনে পাথর ছোড়া গর্হিত অপরাধ! অর্থাৎ, বন্দে ভারতে না পড়ে, ওই পাথর যদি বনগাঁ লোকালে পড়ত, তিনি বোধ হয় অনেক নিশ্চিন্ত হতেন; তাঁর দেশপ্রেম অটুট থাকত!
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, এ বছরের ১৫ অগস্টের মধ্যে অন্তত ৭৫টি এই ধরনের ট্রেন চলবে। তাই নেতাদের বলি, ধীরে, রজনী, ধীরে। সব জমে-থাকা আবেগ, ভুলে-থাকা ক্ষোভ এখনই উগরে দিলে, ভবিষ্যতের ঝুলি যে শূন্য হয়ে যাবে!
দেবাশীষ মিত্র, কলকাতা-৭০
দেশ ও দল
‘মঙ্গলবার কোথায় হামলা, ধন্দ রইল ২৪ ঘণ্টা পরেও’ (৫-১) শীর্ষক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা নতুন নয়। কিছু দিন আগেও বনগাঁ-শিয়ালদহ লাইনের দত্তপুকুরে পাথর ছুড়ে একাধিক মানুষকে জখম করা হয়েছিল। গত বছর মাল জংশনে ঢোকার মুখে আমার এক পরিচিতকে পাথরের আঘাতে জখম হতে হয়েছিল। পুলিশকে জানানোয় ওঁরা জানিয়েছিলেন, ট্রেনের গতি ওই অংশে কমে এলে কিছু নেশাখোর এবং কিছু ক্ষেত্রে ছিঁচকে চোরের দল এমন কাণ্ড ঘটায়। ওই স্থানে ট্রেনের গতি কমলে পর্যটক মোবাইলে দু’পাশের জঙ্গলে ঢাকা পথের ছবি তুলতে গেলে হাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে এক দল দুষ্কৃতকারী। ফোন আচমকা হাত থেকে পড়ে গেলে ওরা নিয়ে পালায়। নেশা করা, বা অভাবের তাড়নায় চুরি করা অন্যায় বটে, তবে তাতে দেশদ্রোহিতার কোনও চিহ্ন থাকে না। কিন্তু বন্দে ভারতে পাথর ছোড়ার ঘটনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। দেশের সংসদীয় রীতি মেনে রাষ্ট্র যে আইন তৈরি করছে, বিরোধী দলগুলি ওই আইনের বিরুদ্ধেই জনমত গঠন করছে, সেই আইনকে অমান্য করার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন, দেশ এবং দলের পার্থক্য গুলিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের সম্পত্তি বিশেষ একটি দলের সম্পত্তি হিসাবে দেখার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না তো?
অতীতে আমরা দেখেছি, একটি দল অন্য দলের কার্যালয় দখল করেছে, বিপক্ষের মানুষকে খুন করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। একই যুক্তিতে বন্দে ভারতে পাথর ছোড়া হচ্ছে না তো? দ্রুত গতির এই ট্রেনে ইচ্ছে করলেই পাথর দিয়ে আঘাত করা কঠিন। তবু তা হল। তাই সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয় না। গত ৩০ ডিসেম্বর ট্রেনটির ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি অনুষ্ঠানে একটি দলের স্লোগান ছুটল, অন্য দলের কোটি কোটি সমর্থক রইলেন মঞ্চের নীচে। তারই কুফল ফলছে না তো?
আজ আমাদের সচেতন হওয়ার পালা। সরকার এবং দলের পার্থক্য ধরতে না পারলে আমরাই আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠব। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তো জনগণেরই সম্পদ।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
অজস্র অনিয়ম
‘পরিকাঠামো তৈরি না হলে’ (৫-১) প্রবন্ধে পার্থ প্রতিম বিশ্বাস ভারতীয় রেলের সার্বিক পরিকাঠামোর অভাব, ক্রমশ নিম্নগামী বাজেট বরাদ্দ এবং জনবিমুখ কর্মকাণ্ডের সাম্প্রতিক খতিয়ান তথ্য-সহযোগে বর্ণনা করেছেন।
যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও রেল কর্তৃপক্ষ চরমতম উদাসীন। বেশির ভাগ দূরপাল্লার ট্রেনে স্লিপার ক্লাসে যাত্রা করা দুষ্কর। জেনারেলে সিট না পেয়ে সাধারণ যাত্রীরা রিজ়ার্ভড কামরায় উঠে পড়েন। সিট দখল, চেপে বসার মতো অন্যায় আবদার কখনও কখনও দাদাগিরির পর্যায়ে পৌঁছয়। প্রয়োজনের সময় টিটিই, আরপিএফ, কারও দেখা মেলে না। ট্রেনের টয়লেটে জলের সমস্যা, কিছু যাত্রীদের কারণে টয়লেট ব্লকেজ, বেসিন ব্লকেজের সমস্যা চিরন্তন। এ ছাড়া টয়লেট পেপার, তরল সাবান অনেক ট্রেনের টয়লেটেই থাকে না। স্লিপার কিংবা এসি কামরা, দুই ক্ষেত্রেই টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য কর্মীর দেখা মেলে না। সংশ্লিষ্ট কোচের বাইরে তাঁদের মোবাইল নম্বর লেখা থাকার নিয়ম থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তা থাকে না, বা ফোন করলেও ওঁরা আসেন না।
বাতানুকূল কামরাতে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত দু’বার সাফাই করার নিয়ম থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। খাবারের দাম, সরবরাহকারী সংস্থা আইআরসিটিসি কর্তৃক বেঁধে দেওয়া থাকলেও অধিকাংশ ট্রেনে তার থেকে বেশি টাকা রেল কর্মচারীরা যাত্রীদের থেকে আদায় করেন। যাত্রী-সাধারণের জেনে রাখা প্রয়োজন, ট্রেনে ভেজ মিল ৮০ টাকা, এগ মিল ৯০ টাকা এবং চিকেন মিল ১৩০ টাকা। এ ছাড়া আরও অন্যান্য খাবারের দাম আইআরসিটিসি-র ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে। এই চার্ট প্রতিটি ট্রেনে থাকার কথা হলেও বাস্তবে থাকে না। এমনকি নিয়ম মেনে খাবারের বিলও দেওয়া হয় না। ট্রেন বা স্টেশনে কেবল ‘রেল নীর’ কিংবা আইআরসিটিসি অনুমোদিত জলের বোতলের মূল্য এক লিটার ১৫ টাকা, তবু যাত্রীদের কাছ থেকে হামেশাই ২০ টাকা নেওয়া হয়।
ভারতীয় রেল সংক্রান্ত অনেক সমস্যা সাম্প্রতিক কালে টুইটের মাধ্যমে সমাধান হলেও, সাধারণ মানুষের কাছে টুইট, সংশ্লিষ্ট টুইট হ্যান্ডেলকে ট্যাগ করা ইত্যাদি প্রযুক্তিগত জটিলতা বোঝা সহজ কাজ নয়। এমনকি, রেলের নিজস্ব অ্যাপ কিংবা ১৩৯-এ ফোন করেও অনেক যাত্রী অভিযোগ জানাতে পারেন না। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটে চলেছেন কিছু অসাধু মানুষ। এই অন্যায় বন্ধ করতে কঠোর নজরদারি, দুর্নীতিদমন দল মোতায়েন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সৌপ্তিক পাল, দাশনগর, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy