Advertisement
১৭ মে ২০২৪
Uttam Kumar

সম্পাদক সমীপেষু: আজও ‘নায়ক’

দেশভাগের যন্ত্রণা, দুর্ভিক্ষ, অনাহারে জীবন দুর্বিষহ, তখন ব্যক্তি ও সমাজের অগ্রযাত্রায় বাংলার মানুষকে একই সঙ্গে রোম্যান্স ও আশাবাদ জুগিয়েছিলেন উত্তমকুমার, রুপোলি পর্দায়।

An image of Mahanayak Uttam Kumar

মহানায়ক উত্তম কুমার। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৩ ০৬:৫০
Share: Save:

অগ্নি রায়ের প্রবন্ধ ‘বাঙালির মহানায়ক’ (রবিবাসরীয়, ২৩-৭)-এর পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্রের অবতারণা। শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া বাংলা সিনেমার ইতিহাসে উত্তমকুমার ‘মহানায়ক’ হিসাবে বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন অনেক লড়াইয়ের পর। রবার্ট ব্রুসের গল্পের মতো বার বার ব্যর্থ হলেও বসু পরিবার-এর পর উত্তমকুমারকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা সিনেমার ‘স্বর্ণযুগ’-এ এক দিকে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ী সম্পূর্ণ নতুন, অন্য এক ঘরানার ছবি বানিয়ে ঘরে-বাইরে আলোড়ন তৈরি করছেন, তখন অন্য দিকে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে উত্তমকুমারের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।

তাঁর উত্থান একাধারে নাটকীয় ও রাজকীয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশ— দেশভাগের যন্ত্রণা, দুর্ভিক্ষ, অনাহারে জীবন দুর্বিষহ, তখন ব্যক্তি ও সমাজের অগ্রযাত্রায় বাংলার মানুষকে একই সঙ্গে রোম্যান্স ও আশাবাদ জুগিয়েছিলেন তিনি, রুপোলি পর্দায়। উত্তম-সুচিত্রা জুটি বাংলা সিনেমায় আজও সেরা জুটি বলে চর্চিত। ওরা থাকে ওধারে, সাগরিকা, পথে হল দেরী, হারানো সুর, অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, জীবন তৃষ্ণা, শিল্পী, সপ্তপদী— আরও অনেক ছবির নাম করা যায় যেখানে দু’জনের অভিনয়ের বোঝাপড়া দর্শকদের মন ছুঁয়েছে। পর্দায় তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন বাঙালিকে নতুন ভাবে ভালবাসতে শিখিয়েছে। উত্তমকুমার তাঁর নয়নাভিরাম হাসি, চোখের চাহনি, সুদর্শন গড়ন, অভিনয়ে এক অননুকরণীয় ‘ম্যানারিজ়ম’ দিয়ে বাঙালির মনের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে, চরিত্রের হাবেভাবে সাজপোশাকে নিখাদ বাঙালি অন্তরাত্মাটি ফুটে উঠত।

উত্তমকুমারের ঠোঁটে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমারের গাওয়া গান যেন তাঁরই কণ্ঠের গান বলে মনে হত দর্শকদের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের দু’জনের কণ্ঠস্বরে অনেক মিল ছিল। সুচিত্রা সেন ছাড়াও তনুজা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেনের মতো অভিনেত্রীদের সঙ্গে জুটিতে তাঁর বহু ছবি আজও দর্শকদের কাছে সমাদৃত। সমস্ত বাঙালির কাছে উত্তমকুমার ছিলেন ‘ম্যাটিনি আইডল’। ১৯৮০ সালে মৃত্যুর পরও মফস্‌সল এলাকার সিনেমা হল-এ বা গ্ৰামের দিকের ভিডিয়ো হলগুলিতে তাঁর ছবি দিনের পর দিন রমরমিয়ে চলেছে।

সময়, সমাজ পাল্টেছে, বদলেছে বাংলা ছবিও, তবু উত্তমকুমার অভিনীত ছবিগুলির কথা আমরা ভুলিনি। নায়ক ছবিতে অরিন্দমের চরিত্রে তাঁর একটি বিখ্যাত সংলাপ ছিল— “আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ।” নানা চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সার্থকতার সেই শিখরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন উত্তমকুমার। তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করে পরম ও বিরল এক তৃপ্তি পাওয়ার কথা। তিনি আরও বলেছিলেন, “এক জন শিল্পীকে সর্বদা তাঁর সেরা কাজ দিয়ে বিচার করা উচিত। উত্তমের মধ্যে বহুমুখী প্রতিভা, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আত্মবিশ্বাসের বিরল গুণাবলি ছিল। এই ধরনের সংমিশ্রণ সহজে আসে না এবং অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় কেউ তার জায়গা নিতে পারবে বলে মনে হয় না।”

অরুণ মালাকার, কলকাতা -১০৩

নিষ্ঠাবান

উত্তমকুমার অভিনয়ের প্রতি কতখানি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তার একটা উদাহরণ শুনেছি আমার মেজো মামা, প্রয়াত গীতিকার শ্যামলেশ ঘোষের মুখে। মহানায়কের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন তিনি,জীবন মৃত্যু এবং জীবন জিজ্ঞাসা ছবিতে একটি করে গানও লিখেছিলেন।

জীবন মৃত্যু ছবিতে পঞ্জাবি চরিত্র শান্তাপ্রসাদকে পর্দায় নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য তাঁর নিষ্ঠা ছিল অসাধারণ। সপ্তাহখানেক ধরে প্রতি রাতে ডিনার শেষে তিনি পৌঁছে যেতেন ভবানীপুর পেট্রল পাম্পে। সেখানে পঞ্জাবি ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাঁদের কথা বলা, হাঁটাচলা এমনকি হাসির কায়দা পর্যন্ত রপ্ত করতেন। এক অর্থে যেন শান্তাপ্রসাদকেই খুঁজতেন। এমনই ছিল অভিনয়ের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা। আজ মহানায়কের প্রয়াণের পরে চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। তবু নির্দ্বিধায় বলা যায়, আগামী কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে অভিনয়-শিক্ষার এক অনন্য অভিধান হয়ে থাকবেন তিনি।

অর্ঘ্য নারায়ণ বসু, কলকাতা-৮৪

ম্যাটিনি আইডল

‘বাঙালির মহানায়ক’ প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। উত্তমকুমারকে দেখে প্রেমে পড়তে শিখেছে বাঙালি। নব্য-প্রেম এখনও বাইক-লগ্ন হয়ে পথ হারাতে চায় নিমেষে। এই ডিজিটাল যুগেও, উত্তমকুমারের হাসির চেয়ে বড় ব্র্যান্ড বাংলা ছবিতে আর কী-ই বা! আজও বহু তরুণী জীবনসঙ্গী খোঁজার সময় কল্পনা করতে চায় উত্তমের মতো সুদর্শন ব্যক্তিত্ব,যাঁর মধ্যে থাকবে নম্রতা-ভদ্রতা, দৃষ্টিনন্দন হাসি।

সুপ্রিয়া দেবী, শর্মিলা ঠাকুর, মালা সিন্‌হা, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়-সহ বহু নায়িকার সঙ্গে একের পর এক জুটিতে সফল মহানায়ক। তবে উত্তম-সুচিত্রা জুটির অমরত্ব নিয়ে কখনওই প্রশ্ন তোলা সম্ভব নয়। শুধু রোম্যান্টিক ছবি কেন— পরবর্তী কালে উত্তমকুমারের অভিনয়-প্রতিভার কদর করেছেন সত্যজিৎ রায়ের মতো কিংবদন্তি পরিচালকও। নায়ক ছবির নায়ক অরিন্দম আর উত্তমকুমার জনমানসে ‘এক’। সত্যজিৎ রায় তাই ‘ম্যাটিনি আইডল’ হিসাবে উত্তমকুমারকেই বেছে নিয়েছিলেন।

ছোটি সি মুলাকাত-সহ হিন্দি ছবিগুলিও উত্তমকুমারের অভিনয়-কেরিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ। ছবিগুলির ব্যবসায়িক সাফল্য বা উত্তমকুমারের হিন্দি ছবিতে নায়ক হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যত কথাই উঠুক না কেন, তাঁর দুঃখ ছিল যে তাঁকে নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি কেউ। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “দর্শকের অসীম ধৈর্য, আমার এই বয়সে, এখনও তাঁরা আমাকে রোম্যান্টিক নায়করূপে সহ্য করছেন। এক-এক সময় মনে হয়, তাঁদের প্রতি আমি অবিচার করছি।” প্রথম দিকের লড়াইয়ের কষ্টটা শেষ দিকেও থেকে গিয়েছে অন্য ভাবে। বাঙালির লড়িয়ে দেওয়ার স্বভাব, উত্তম বনাম সৌমিত্র-র ‘বাইনারি’ সে বজায় রেখেছে। কিন্তু পর্দায় ‘অ্যাপিল’-এর ধারে-ভারে উত্তমকুমার অন্য স্তরের ‘অভিজ্ঞতা’।

ষাটের দশকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে পথে নামবেন কলকাতার চলচ্চিত্র শিল্পীরা। দেখা গেল, যাঁরা হাঁটবেন সেই তালিকায় উত্তম নেই। বিকাশ রায়কে উত্তম বললেন, “কেন, আমি কি পির ঠাকুর নাকি?... আমি ঘরে বসে থাকব না।” পথে যে সব কাণ্ড ঘটল তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে কী বিপুল উন্মাদনা। অসম্ভব ভিড়ে মেয়েরা গলার সোনার হার, হাতের চুড়ি পর্যন্ত খুলে ছুড়ে দিতে লাগলেন উত্তমকুমারের নামে। শেষে বাড়ির পুরুষদের অনুরোধে ফিরে যেতে হয়েছিল নায়ককে। সেই আমলের কলকাতার রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের এই অবিশ্বাস্য উত্তম-প্রীতির গল্প হার মানাবে এখনকার যে কোনও নায়কের জনপ্রিয়তাকে। মৃত্যুর চার দশক পরেও উত্তমকুমার একই রকম চিত্তাকর্ষক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা উত্তমের ঠোঁটে বিশ্বাস করেছে, ‘গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশ তো’। উত্তমকুমার নিজেই সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE