Advertisement
১২ মে ২০২৪
Netaji Subhas Chandra Bose

সম্পাদক সমীপেষু: নেতাজির আদর্শ

রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ১৯৪২-এ গান্ধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে তিনি সমর্থন জানান।

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০০
Share: Save:

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের ‘নিন্দা করা কর্তব্য’ (১৩-৪) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রতিভূ সুভাষচন্দ্র বসু ধর্মীয়, জাতিগত সঙ্কীর্ণতাকে চিন্তার জগতে স্থান দেননি। তাঁর ভারত ভাবনা সাভারকর, গোলওয়ালকরদের ভারতভাবনা থেকে ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। তিনি এ দেশে হিন্দু অতীতকে নির্মাণ করতে চাননি। মনে করতেন, ভারতে মুসলমান শাসকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ একটি নতুন সমন্বয় গড়ে ওঠে। তাঁর লেখা দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইটি পড়লে এ কথা বোঝা যায়। রেঙ্গুনে গিয়ে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে তিনি চাদর চড়িয়েছিলেন। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার চরিত্রে কালিমালেপনকারী ব্রিটিশদের নির্মিত স্মৃতিচিহ্ন ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ উৎখাতে উদ্যত হন নেতাজি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরি থেকে জানা যায় বাংলার রাজনীতির সঙ্গে হিন্দু মহাসভার সংযুক্তিকরণের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে আশাব্যঞ্জক ফলাফলে উচ্ছ্বসিত জওহরলাল ঘোষণা করেন ভারতে দু’টিই মাত্র পার্টি— ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস। এতে ক্ষুব্ধ হন জিন্না ও মুসলিম লিগের সদস্যরা। নেতাজি-জিন্না পত্রালাপ পড়লে বোঝা যায়, এই ফাটল মেরামতে কতটা তৎপর ছিলেন সুভাষ বসু।

রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ১৯৪২-এ গান্ধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে তিনি সমর্থন জানান। ব্রিটিশ-বিরোধী বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে মজলিশ-ই-আহরার, আজ়াদ মুসলিম লিগ, অকালি দলের প্রতি তাঁর আহ্বান পৌঁছয়। নেতাজির স্বপ্নের আজ়াদ হিন্দ বাহিনীতে হিন্দি ও উর্দুর মিশেলে হিন্দি প্রচলিত ছিল। ছিল ফৌজি ক্যান্টিনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একত্রে খাওয়ার ব্যবস্থা। আজ়াদ হিন্দ রেডিয়োর বেতারবার্তায় হবিবুর রহমান এবং এ এম সুলতানের দায়িত্বে চালু হয় ‘আজ়াদ মুসলিম রেডিয়ো’-র সার্ভিস। দ্বিজাতি তত্ত্বের যে বিষবৃক্ষে ইংরেজ শাসকরা সার দিচ্ছিলেন, মহাজাতির জাগরণের উদ্গাতা নেতাজি সেই বৃক্ষকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। (সূত্র: সুমিত মিত্র, আত্মসাৎ: নেতাজি এবং আইএনএ, বিশ্বজিৎ রায়, ‘সুভাষচন্দ্র, মোদী ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ’, দেশ, ২-১১-২০১৮)

স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

‘প্রেম কি মালা’

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। নেতাজি সমন্বয়ী রাজনৈতিক দর্শন নির্মাণে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতের মতো বৈচিত্রপূর্ণ দেশে সর্বধর্ম সমন্বয় ও সকল মতের প্রতি সহিষ্ণুতার দ্বারাই নির্মিত হতে পারে জাতীয়তার সৌধ। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত। তিনি সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধীয় ধারণাও পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে। এমনকি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্মাণেও তাঁদের ছায়া ছিল। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক নেতাজি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার বিকাশ। জাতপাত, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। আজ়াদ হিন্দ ফৌজে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, পরমতসহিষ্ণু নীতির প্রয়োগ ঘটান। সিঙ্গাপুরে আজ়াদ হিন্দ সরকার ঘোষণার সময় (অক্টোবর, ১৯৪৩) আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেনকে দিয়ে ‘জনগণমন’ গানটির মূল ভাব সরল হিন্দুস্থানি ভাষায় তর্জমা করান। আজ়াদ হিন্দের সেনানীরা গেয়েছিলেন, “সব কে দিল মে প্রীত বসায়ে তেরি মিঠি বাণী/ হর সুবে কে রহনে ওয়ালে হর মজ়হব কে প্রাণী/ সব ভেদ ঔর ফারাক মিটাকে, সব গোদ মে তেরি আকে/ গুঞ্জে প্রেম কি মালা।” (‘মহাজাতির স্বপ্ন ও সুভাষচন্দ্র’, সুগত বসু, দেশ, ১৭-০১-২০২২)। ব্যক্তিগত জীবনে সুভাষচন্দ্র আধ্যাত্মিক, হিন্দু ও মাতৃশক্তির উপাসক হলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে স্থান দেন আঞ্চলিকতা ও ধর্মীয় পরিচিতির উপরে। আজ়াদ হিন্দ ডাকটিকিটে রয়েছে তাঁর সুসংহত ভারতবর্ষের পরিচয়। আজকের হিন্দুত্বের সঙ্গে তাঁর হিন্দু ধর্মবোধের সাদৃশ্য খুঁজতে যাওয়া অসমীচীন।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

বিকৃত তথ্য

‘নিন্দা করা কর্তব্য’ সময়োপযোগী। নেতাজি দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি সম্পর্কে গভীর ভাবে সচেতন ছিলেন। দেশবাসীকে সতর্ক করে ৪ মে, ১৯৪০ ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশের এবং অন্যত্র হিন্দুদের মন বিষিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক বিষ উদ্গার করে চলেছে। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির কঠোর সমালোচনা করে ৭ জুলাই, ১৯২৯, যশোর জেলা সম্মেলনে সতর্ক করেছিলেন যে, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোক উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই শ্রেণির লোককে শত্রুর মধ্যে গণ্য করা প্রয়োজন। ১৪ জুন, ১৯৩৮ কুমিল্লার ভাষণে বলেছিলেন— হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া হিন্দুরাজের ধ্বনি কেবল অলস চিন্তা। দেশ থেকে কী ভাবে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যায় সে সম্পর্কে ৩ মে, ১৯২৮ সালে মহারাষ্ট্রের প্রাদেশিক সম্মেলনের ভাষণে বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক বিরোধ মীমাংসার প্রয়োজন। প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর ঐতিহ্য, আদর্শ ও ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হলে, সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পথ সহজ হবে। তার জন্য দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা।

ইংরেজ শাসকেরা এ দেশে তাঁদের শাসনের গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করতে, মুসলমান শাসকদের মন্দির ধ্বংস, ধর্মান্তরকরণ, হত্যার ইতিহাসকে তাঁরা বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আজ আমরা দেখছি, উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানের নাম একের পর এক বদল করে হিন্দু নামকরণ করা হয়েছে। শতাব্দী-প্রাচীন স্থাপত্যকে গায়ের জোরে গুঁড়িয়ে, ক্ষমতার জোরে আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। চলচ্চিত্রে, দূরদর্শনে মুসলমান শাসকদের অত্যাচার লোলুপতাকে যতটা নির্মম ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, ততটাই হিন্দু রাজাদের বীরগাথা, মাহাত্ম্যকে তুলে ধরা হচ্ছে। ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিগুলিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণের পরিবর্তে ইতিহাসকে বেশি করে বিকৃত করা হচ্ছে।

মঙ্গল কুমার নায়ক, কোতয়ালি, পশ্চিম মেদিনীপুর

জনজাতি?

কুর্মি মাহাতো বিষয়ে কিছু ভুল ধারণার উপরে আলোকপাত করতে চাই। অনেকে হয়তো মনে করছেন, কুর্মি মাহাতোরা জনজাতি হিসাবে গণ্য হলে জনজাতি সম্প্রদায়ের লাভই হবে। তারা সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে, সম্মিলিত শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠবে। বাস্তবে কিন্তু এই সমস্যাগুলি দেখা দেবে। ১) জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন প্রধানত কুর্মিরা দখল করবেন। কারণ অনেক কাল আগে থেকেই তাঁরা জানজাতি সম্প্রদায়ের তুলনায় সব দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছেন। যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে তাঁরাই এগিয়ে থেকে স্থান দখল করবেন। ২) বর্তমানে কোনও জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের জমি অন্যরা কিনতে পারে না। কুর্মি মাহাতোরা জনজাতি হয়ে গেলে সাঁওতাল প্রমুখ জনজাতিদের সব জমি তাঁদের হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা, কারণ তাঁরা অর্থবলেও বলীয়ান। ৩) কুর্মি মাহাতোরা হিন্দু দেবদেবীর পুজো করেন, সব ক্রিয়াকর্ম পুরোহিত দিয়ে করেন। কিছু দিন আগে পর্যন্তও তাঁরা দৈনিক পত্রিকায় কুর্মি ক্ষত্রিয় মাঙ্গলিক পরিচয় দিয়ে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। এখন তাঁরা নিজেদের জনজাতি হিসাবে প্রতিপন্ন করতে পুস্তিকা, লিফলেট, দেওয়াল লিখন ইত্যাদিতে নিজেদের ‘আদিবাসী কুর্মী সমাজ’ বলে প্রচার করছেন।

বিশ্বনাথ মুর্মু, খাটখুরা, ঝাড়গ্রাম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE