শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ (‘হাজার বছরের পিছিয়ে পড়া’, ১৫-৯) প্রসঙ্গে বলতে চাই, বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থানের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের জন্মও জড়িয়ে আছে। সেই সময় বাংলার বিপুল সংখ্যক নিম্নশ্রেণির মানুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে সুফি পির-ফকিরের আশ্রয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাঙালি মুসলিম মূলত বৌদ্ধ ধর্ম, নাথ ধর্ম, হিন্দু ধর্মের শূদ্র শ্রেণি থেকে আগত। বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষয়কালে শিবকে কেন্দ্র করে বাংলায় গড়ে ওঠে নাথ ধর্ম। সেই রকমই পির-ফকিরকে গুরু মেনে লৌকিক ইসলাম গড়ে ওঠে বাংলায়। বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আসা হিন্দুরা আগের বৌদ্ধ পদবি এখনও ব্যবহার করেন। ঘোষ, বসু, পাল, ভদ্র, নাথ প্রভৃতি বল্লাল সেনের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানের আগের বৌদ্ধ নামগুলির শেষাংশ। তেমনই বাঙালি মুসলমানদের অনেকে আজও হিন্দু পদবি ব্যবহার করেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদের কাঠামো থেকে বেরিয়ে না গেলে এত দিনে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে বর্ণবাদী ব্যবস্থা ভেঙে যেত। হয়তো ব্রাহ্মণ্যবাদীরা চেয়েছিলেন, প্রতিবাদীরা বেরিয়ে যাক। সেই যে পারস্পরিক অসম্মানের বীজ বপন হয়েছিল, তা এখনও হিংসা, ঘৃণা দিয়ে লালন হচ্ছে।
এই অনৈক্যকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক রাজনীতি তার বুনিয়াদ শক্ত করছে। অথচ ঐক্যের দিকটি কেউ খেয়াল করে না। হিন্দু সংস্কৃতির পরতে পরতে যেমন বৌদ্ধ সংস্কৃতি জড়িয়ে, তেমনই বাঙালি মুসলমান আজও অনেক ক্ষেত্রে পুরাতন সংস্কৃতির ধারক। বাংলার ইসলাম লৌকিক ইসলাম। ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ, সত্যপিরের উত্থান গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ ধর্মের পরিণতি জনপ্রিয় ‘ধর্মঠাকুর’। নাথ ধর্মে পূজিত হতেন ‘সত্যদেব’। এই ‘সত্যদেব’-ই মুসলমানের কাছে ‘সত্যপির’ হয়ে ওঠেন। সত্যপিরের ধারণার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ‘নারায়ণ’-এর ধারণা যুক্ত হয়ে ‘ধর্মঠাকুর’, ‘সত্যদেব’ বদলে যান ‘সত্যনারায়ণ’-এ। বাংলায় মধ্যযুগ থেকে ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত যৌথ সাধনার চেষ্টা করা হয়েছে। কবীর, রামানন্দ, নানকের মতো সন্তদের ধর্ম আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিম্নবর্ণের মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদ ও উত্তর ভারতে সন্তধর্মের উদ্ভব ঘটে ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবে।
চম্পা খাতুন, কলকাতা-৯৯
বিচ্ছিন্নতার নীতি
বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সংযোজন করতে চাই। দীর্ঘ কাল শাসনক্ষমতায় থাকার সুবাদে ব্রিটিশ শাসক বুঝতে পারে, জমিদার ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের কারণে তারা জনগণের গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন পাচ্ছে না, এবং এই অংশ ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের ধারার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। হিন্দু সমাজের বঞ্চিত অংশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার তাগিদে নির্যাতিত মানুষের জন্য তারা কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদ্রাজ প্রাদেশিক বিধান পরিষদ ১৮৮৫ সালে বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য নতুন ‘গ্রান্ট-ইন-এড’ বিধি রচনা করে এবং পরে ১৯২১ সালে বিধান পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে মাদ্রাজ প্রাদেশিক সরকার সরকারি চাকরিতে অব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাজ্যের সম্প্রদায়গুলিকে মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের জন্য আলাদা কোটা স্থির করা হয়। মহীশূর, বম্বে ও অন্যান্য প্রাদেশিক সরকারও সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। সরকারি নথি ও দস্তাবেজে বঞ্চিত শ্রেণিকে তফসিলি জাতি-জনজাতি হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। ১৯৩১ সালের জনগণনায় ‘এক্সটেরিয়র কাস্ট’ কথাটি ব্যবহার করে শুধুমাত্র অস্পৃশ্য জাতিকে চিহ্নিত করা হয়।
গাঁধীজি ব্রিটিশদের মতলব বুঝে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক যে কর্মসূচি রচনা করেন, সেখানে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রামও স্থান পেয়েছিল। ব্রিটিশরা এর পরে বঞ্চিত শ্রেণির জন্য বর্ণহিন্দুদের থেকে আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন থেকে এক গরিষ্ঠ অংশকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। ১৯৩২ সালে গাঁধীজি এর বিরুদ্ধে কারাবন্দি অবস্থাতেই আমরণ অনশন শুরু করেন। ফলস্বরূপ, বর্ণহিন্দু ও বঞ্চিত শ্রেণির নেতাদের মধ্যে এক চুক্তি হয়। এর আগে অবশ্য বঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থক ও বিরোধীরা এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটাই হয় ভিত্তি, যার উপরে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণীত হয়।
সুকোমল মাসচারক, কলকাতা-১৩৭
পদবি বর্জন
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, সংরক্ষণ নীতি গত শতাব্দীর ঐতিহাসিক অবিচার ও বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ। তা হলে গত ৭০ বছরে এই নীতির যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার জন্য যে বঞ্চনা, তার ক্ষতিপূরণ কারা দেবে? তা হলে তো সংরক্ষণ নীতি প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার অস্ত্র! এই নীতিতে সমতার লক্ষ্যপূরণ অপেক্ষা জাতিভেদ প্রথা আরও বেশি করে সমাজে শিকড় বিস্তার করছে। সংরক্ষণ দিয়ে কিছু মানুষের বংশপরম্পরায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু যোগ্যতা বা সমাজিক সমতা? তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, সচেতনতা, সামাজিক সুরক্ষা, আর্থিক সহায়তা। বর্তমানে জাতব্যবস্থার সঙ্গে বৃত্তির যোগাযোগের আর বাধ্যবাধ্যকতা নেই। তাই প্রশ্ন উঠবে, দলিতরা কি নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চেয়েও বেশি অত্যাচারিত? সমতা বিধানের জন্য শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে পদবি বর্জন হোক। বিদ্যালয় থেকে জাত না-মানার শিক্ষা শুরু হোক। সংরক্ষণের করুণা নয়, আত্মমর্যাদা তৈরি হোক দলিতদের।
মিলি মাইতি, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর
প্রশ্নে সংজ্ঞা
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের নিবন্ধ (‘দলিত শব্দটি প্রতিবাদের প্রতীক’, ২৪-৯) প্রসঙ্গে বলতে চাই, প্রশ্নটি দলিত সাহিত্যের সংজ্ঞা নিয়ে, দলিত সাহিত্য অস্বীকারের প্রশ্নে নয়। দলিতদের দ্বারা লিখিত সাহিত্যই কি একমাত্র দলিত সাহিত্য? দেবেশ রায় কিংবা মহাশ্বেতা দেবী তবে কি দলিত সাহিত্য রচয়িতার তকমা পাবেন না শুধুমাত্র বংশ পরিচয়ের কারণে?
‘দলিত’ শব্দটি ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়েছে স্বাধীনতার অনেক পরে। অওরঙ্গাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক গঙ্গাধর পান্তবানে সম্পাদিত ত্রৈমাসিক অস্মিতাদর্শ পত্রিকায় ‘দলিত সাহিত্য’ শব্দবন্ধটি প্রথম পাঠকের কাছে পৌঁছয়। এই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি মহারাষ্ট্র। জ্যোতিবা ফুলে-র মাধ্যমে এই আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ইতিপূর্বে অম্বেডকর সম্পাদিত পত্র-পত্রিকা মুখনায়ক, জনতা, প্রবুদ্ধ ভারত অথবা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘পিপলস এডুকেশন সোসাইটি’-র সক্রিয়তায় এই বিষয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি হলেও, এর বিস্তৃতি ঘটে পরবর্তী কালে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরিতে জনমানসে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এটি সাহিত্যের নতুন কোনও শাখা নয়। বাংলায় দলিত সাহিত্য চর্চার শুরু ১৯০৯ সালে রাসবিহারী রায় সম্পাদিত নমঃশূদ্র দর্পণ দিয়ে। তার পর ১৯১১ সালে শশীকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত নমঃশূদ্র দ্বিজতত্ত্ব। বলরাম সরকারের নমঃশূদ্র জ্ঞানভাণ্ডার ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মজুমদারের নমঃশূদ্র চন্দ্রিকা তারও পরে। শরণ কুমার লিম্বালের বেজন্মা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন এটি এক শূদ্রাণীর আত্মোপাখ্যান। ‘দলিত প্যান্থার’ নামে এক সংগঠন গড়ে সাহিত্য আন্দোলনে ব্রতী হন মরাঠি দলিত কবি নামদেও ধাসাল।
দলিত লেখকের লেখা হলেই যে তা দলিত সাহিত্য হবে, এ কথা অনেকেই মানতে চান না। দলিত লেখকদের জন্য ভিন্ন মানদণ্ড নেই। ১৯৭৫ সালে দলিত কবি বোয়ি ভিমান্না, ১৯৯০ সালে কন্নড় সাহিত্যিক দেবানুর মহাদেব, ২০০৪ সালে দলিত বর্গের নারী গীতা দেবীর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাওয়া সংরক্ষণের ফলে ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গে নলিনী বেরার আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তিও তার উদাহরণ।
পার্থ প্রতিম কুণ্ডু, কলকাতা-৫৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy