রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটি রোড ক্যাম্পাস চত্বরে এমনই ছবি ধরা পড়েছে। —ফাইল চিত্র
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্তোৎসবের রকমটি দেখিবার পর কিছু অপ্রিয় কথা বলিবার দরকার হইয়া পড়িয়াছে। বাঙালির জীবনে উৎসব বন্ধ করিয়া দিলে তাহার আর কিছুই থাকে না ঠিকই, তবু বসন্তোৎসব নামে আজকাল যাহা চলিতেছে, তাহা কী ও কেন, এই গোড়ার বিষয়টি আর এক বার ভাবিতে হয়। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মাদকদ্রব্যের এই প্রবল উপস্থিতি ও মাদকপ্রভাবে ছাত্রদের অপার গড়াগড়ির ছবি কেবল সেই প্রতিষ্ঠানকে নহে, পুরা রাজ্যকেই লজ্জায় অধোবদন করিয়া দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাথা হেঁট হওয়া উচিত যে তাঁহারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের এমন ছবি ও সংবাদ দেশময় ছড়াইতে দিতেছেন। এমন একটি ঘটনা কিন্তু অনেক কালের অনেক অর্জনকে বাতিল করিয়া দিতে পারে। শোনা গিয়াছে, উপাচার্য মহাশয় খোঁজ লইবেন। সুখের কথা। কিন্তু খোঁজ লইয়া তিনি কী করিবেন, জানিতে পারিলে সুখটি পূর্ণ হইত। কোনও দ্বিধাসংশয় না রাখিয়া তাঁহার উচিত এই ধরনের অশালীনতার ক্যাম্পাসব্যাপী চর্চা নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়া। অবশ্যই ইহা কেবল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সমস্যা নহে। রাজ্যের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজেই দোলে উৎসবের নামে অনাচার দেখা যায়। বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যময় বসন্তোৎসবটি পৌরাণিক বা মধ্যযুগীয় দোলকাহিনির সহিত সম্পর্করহিত, কিন্তু গত কয়েক দশকে সেখানেও দোল-সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব বসন্তোৎসবকে হারাইয়া দিয়াছে, এবং শান্তিনিকেতনকে দোল-ছুটিতে একটি বিভীষিকায় পরিণত করিয়াছে। দেখিয়া শুনিয়া দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’র নাট্যদৃশ্য মনে পড়িবার জোগাড়— যেখানে বঙ্গীয় বাবুরা জানিতেন আনন্দ ও বিনোদনে মাতিয়া থাকাই জীবনের অর্থ, এবং বিনোদনের অর্থ হইল মদ্যপান ও যথেচ্ছাচার।
অন্য একটি কারণেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কড়া হাতে এই উৎসব বন্ধ করা প্রয়োজন। যে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে মাতিবেন বলিয়া ঠিক করিয়াছেন, তাঁহাদের শাসনের পাশাপাশি, যাঁহারা এই আনন্দে অংশ লইতে বাধ্য হন, সেই ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবাও কর্তৃপক্ষেরই কাজ। বাস্তবিক, এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী উৎসবপালনের প্রাবল্যে দিশাহারা বোধ করেন, এবং নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘বন্ধু’ নামক যথেচ্ছাচারীর দল তাঁহাদের রং মাখাইয়া জ্বালাতন করে। কলেজ-র্যাগিং নিষিদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু সেই র্যাগিংয়েরই আর একটি অবকাশ মিলিয়া যায় দোলের সময়— কথাটি খুব অতিরঞ্জন নয়। এখন, প্রশ্ন উঠিতে পারে, অন্যের উপর জবরদস্তি করিবার এতখানি স্বাধীনতা পৃথিবীর আর কোনও উৎসবে পাওয়া যায় কি— কোনও দেশে, কোনও সংস্কৃতিতে?
কেহ তর্ক জুড়িতে পারেন, কৃষ্ণকে যে গোপিনীরা পিচকারি হাতে তাড়া করিতেন, তাহার মধ্যে কেবল জবরদস্তি নাই, আর একটি আখ্যানও আছে— যৌন সমীকরণ উল্টাইয়া নারী-সক্ষমতার আখ্যান। উত্তর-আধুনিক তার্কিককে সে ক্ষেত্রে একটি কথা মনে করাইয়া দিতে হয়। বর্তমান যুগের নারীরা গোপিনীদের অপেক্ষা বহু ভাবে সক্ষম ও স্বাধীন, এবং চিন্তায় প্রাগ্রসর। সুতরাং পুরুষকে শায়েস্তা করিবার সুযোগের জন্য তাঁহাদের দোলপূর্ণিমা অবধি অপেক্ষা করিবার কী দরকার। আর যদি বিপরীত ছবিটির কথা উঠে, অর্থাৎ, পুরুষরা কী ভাবে গোপিনীদের রং মাখাইয়া দোলসুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন, তবে বলিতে হয় যে সভ্য দুনিয়ায় এই কাজের একটি নাম আছে: নির্যাতন। আর একটি শেষ কথা। নির্যাতনের জন্য সব সময় লিঙ্গভেদ দরকার হয় না। যে সব পুরুষ কিংবা মহিলা কোনও কারণ ছাড়াই দোল খেলিতে অনিচ্ছুক, তাঁহাদের অনিচ্ছাকে না মানাটাও কিন্তু নির্যাতনের পর্যায়েই পড়ে। ‘না’ কথাটির মানে যে ‘না’, এই কথা সমাজে দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিবার সময় আসিয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy