সংসদ ভবন। ফাইল ছবি
ভোট-উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। চারদিকে দেওয়াল লিখন, ফ্লেক্স আর প্রচারের ধুম। বিভিন্ন সভায় প্রার্থীরা ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, ক্ষমতায় এলে সামনের পাঁচ বছরে জনগণের জন্য কী করবেন। আপামর জনসাধারণের একটা বড় অংশ কিন্তু ভুলেও প্রশ্ন করছেন না যে আগের পাঁচ বছর যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রতিশ্রুতি কতটা পালন করেছেন।
ভোটের বিজয়ী প্রার্থীরা এক একটি অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়ে যাবেন দিল্লি, লোকসভায়, নিজের নিজের অঞ্চলের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে। সরকারের বিভিন্ন কাজের খতিয়ান নিতে। সেখানেও একাধিক সাংসদ প্রশ্ন না-করার রোগে আক্রান্ত। ভোট দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সংসদে পাঠানোর উদ্দেশ্যই হল জনতার না পাওয়া, বিভিন্ন অসুবিধার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া। যৌথ শাসনে আমরা সরাসরি কেন্দ্রে যেতে পারি না নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে। লোকসভার নির্বাচিত সদস্যেরা হলেন জনতার সেই মাধ্যম। কিন্তু তাঁরাও যদি কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করতে অস্বস্তি বোধ করেন, তা হলে, সমস্যাটা উন্নয়নের খাতে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়।
সংসদে অধিবেশনের প্রথম ঘণ্টায় সাংসদেরা যে কোনও প্রশাসনিক বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মন্ত্রী সে প্রশ্নের উত্তর দেবেন। গত ২০১৪-১৯ লোকসভাতে মোট ১.৪২ লক্ষ প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার মধ্যে ৩১ জন সংসদ একটিও প্রশ্ন করেননি। প্রশ্ন থেকে যেমন বিতর্ক শুরু হয়, তেমনই বিতর্কে যোগ দিতে গেলেও প্রশ্ন করতে হয়। শেষ পাঁচ বছরে সংসদে বিভিন্ন সংসদীয় কার্যকলাপ, যেমন প্রশ্ন করা, বিতর্কে যোগ দেওয়া, নিজেদের বরাদ্দ অর্থ খরচ করা— সব মিলিয়ে একটি সংস্থা যে ১০ জন সাংসদের তালিকা করেছে, তাঁদের মধ্যে এক জনও পশ্চিমবঙ্গের নন। আমরা আজও প্রশ্ন না-করার রোগে আক্রান্ত। প্রশ্ন না করার মোক্ষম অর্থ হল, যা হচ্ছে সেটা ভুল বা ঠিক—যা-ই হোক, মুখ বুজে মেনে নেওয়া। কোনও প্রশ্ন যদি না থাকে, তা হলে, গণতন্ত্র কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়। প্রকৃত গণতন্ত্র তবেই হবে, যদি জনপ্রতিনিধিরা সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
একটি জায়গায় সব প্রশ্নই মিলে যায়। ক্ষমতার অক্ষে প্রশ্ন অবশ্যই নিম্নমুখী হতে পারে কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী নৈব নৈব চ। আসলে নিম্নমুখী প্রশ্নকে আবার প্রশ্ন বলাই বা কেন? সে তো উপদেশ, নির্দেশ বা আদেশ। আসলে প্রশ্ন করাটাকে আমরা কেবল সমালোচনার চশমা দিয়ে দেখি আর ভুলে যাই যে ওটা আসলে সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। সেই সংস্কৃতি লালন করে গড়ে তুলতে হয়। প্রশ্ন হল আমরা সেটা করি কি? তাই প্রশ্ন করার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আমাদের নিজেদের দিকেও তাকিয়ে নেওয়া বোধ হয় জরুরি।
উচ্চশিক্ষায় আসা ছাত্রছাত্রীদের উপরে একটা সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশ্ন করতে তাঁদের ভীষণ অনীহা। সমীক্ষায় তাঁদের বলা হয়েছিল কেন ক্লাসে প্রশ্ন করতে চান না, নাম ও রোল নম্বর না জানিয়ে লিখতে। সমীক্ষা শেষে দেখা গিয়েছিল যে, তাঁদের কারণগুলি আপাত ভাবে বিভিন্ন ধরনের হলেও প্রত্যকের মর্মার্থ এক–‘ছোটবেলা থেকে আমাদের কেউ প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করেনি’ বা ‘প্রশ্ন করলে অনেক সময় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে’। তাই প্রশ্ন করতেও তাঁদের ভীষণ কুণ্ঠা বোধ হয়।
শ্রেণিকক্ষের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘প্রশ্ন না-করা’র অভ্যাস এখন সর্বত্র। চারদিকে তাকালে, আর একটু সচেতন ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাব—যারা যেটুকু ক্ষমতার পরিসরে রয়েছেন, তাঁরা সেখানে প্রশ্ন চান না। চাই প্রশ্নহীন আনুগত্য। আর এই মানসিকতাই আমদের মধ্যে প্রশ্ন না- করার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে।
ধরা যাক বাড়ির কথা। ছোটবেলায় একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে যখন প্রশ্ন করে আর প্রশ্নটা যদি ‘বেয়াড়া’ হয়, (ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে) আমরা তখন ধমকে তাদের থামিয়ে দিই। সেই ধমকের প্রভাব কিন্তু তাদের সারা জীবনেই থাকে। তারাও না বলতেই বুঝতে শিখে যায় কোন প্রশ্নটা ‘ক্ষমতাবান’কে করা যায় না। তারা বিশ্বাস করতে ভুলে যায়, ভুলকে ঠিক করতে গেলে প্রশ্ন থাকা দরকার। প্রশ্ন ভুল হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে গেলে প্রশ্ন করা জরুরি।
সব প্রশ্নই সমস্যা নয়। সমস্যা হল ‘ক্ষমতাবান’-এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন, যা তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারে বা তাঁর ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারে। ‘ক্ষমতাবান’ (লিঙ্গ নির্বিশেষে) এক বার ধমকে যদি বুঝে যান যে তিনি প্রশ্নকারীকে স্থায়ী ভাবে চুপ করাতে পারেননি, তখন হয়তো সুযোগ খুঁজবেন সবার সামনে প্রশ্নকর্তাকে অপমান করার, যাতে আর প্রশ্ন না আসে। যদি উদাহরণ খুঁজতে যাই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। ‘ক্ষমতাবান’ তাঁর ক্ষমতার নীচে প্রশ্নকারীকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা অন্য গ্রহ থেকে আসেন না। তাঁদের অনেকেই আমাদের আশপাশ থেকে উঠে আসা এক জন। তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন করা নিয়ে যে পরিবর্তন দেখতে চাই, নিজেদের মধ্যে সে পরিবর্তনটা আগে আনতে হবে। তাই প্রত্যেকের উচিত সচেতন ভাবে প্রশ্ন করতে শেখা। প্রশ্ন করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। প্রশ্নই মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোলে। শিক্ষিকা-শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বলতে পারি, ক্লাসে যে ছেলেটা বা মেয়েটা না বুঝে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলে, বিরক্ত না হয়ে বোঝানো উচিত কেন ওই প্রশ্নটা সে জায়গায় অপ্রাসঙ্গিক বা কোন ক্ষেত্রে সেটা প্রাসঙ্গিক হবে। তবে কাটবে ভয়। আর কে বলতে পারে কালকের প্রজন্মের আজকের ক্লাসে প্রশ্ন করার অভ্যাস এক দিন তাদের সমাজে জনতার বঞ্চনার বিরুদ্ধেও প্রশ্ন করতে শেখাবে না!
গোপা সামন্ত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলের শিক্ষক এবং সুমনা কোনার অতিথি শিক্ষক, বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয় ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy