১৯৫৩ সালে, পাকিস্তানের লাহৌরে সাম্প্রদায়িক হিংসা এতটাই ভয়াবহ আকার নেয় যে, বাধ্য হয়ে সেনার শরণাপন্ন হতে হয় প্রশাসনকে। দুই মাসের চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পূর্বে প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে সেনাবাহিনী। শহরের জঞ্জাল সাফাই থেকে শুরু করে সরকারি ভবনের সাফ-সুতরো, রাস্তাঘাট মেরামত, বৃক্ষরোপণ, বেআইনি নির্মাণ গুঁড়িয়ে দিয়ে পুরনো শহরকেই নতুন চেহারায় ফিরিয়ে দেয়। যে কাজগুলি দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে ছিল, সেগুলি এমন দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ায়, সেনাবাহিনী রাতারাতি মহানায়কের সংবর্ধনা পায়। সেনার এই কৃতিত্ব ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয়।
পরিণতি হল অকল্পনীয়। ১৯৫৮ সালে যখন গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণ করে সামরিক বাহিনীর হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়, জনগণ তার বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, দু’হাত তুলে সেনাকেই অভিনন্দন জানায়। পাকিস্তানের আকাশে-বাতাসে তখন ধ্বনিত হতে থাকে, ‘‘পাকিস্তান মে আব তো মাশাল্লাহ (‘মার্শাল ল’, কিন্তু এখানে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ’) হো গয়ে।’’
ভারত এখনও পাকিস্তান হয়ে যায়নি ঠিকই। তবে পাকিস্তানের রাজনীতির সামরিকীকরণের ইতিহাস বুঝতে হলে এই ঘটনাটির উল্লেখ জরুরি। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী একটি জনসভায় নতুন ভোটারদের কাছে আবেদন করেছেন, তারা যেন পাকিস্তানের বালাকোটে হামলা করা সেনাদের কথা ভেবে ভোট দেয়। সেই সঙ্গে, পুলওয়ামায় নিহত আধা সেনাদের স্মৃতিতেও ভোট উৎসর্গ করার আহ্বান জানান তিনি। এক জন নির্বাচিত শাসকের এ ভাবে সেনার নাম ব্যবহার করে ভোট চাওয়া, সেনাকে রাজনীতির অংশীদার করে ফেলার প্রবণতা দেখে বিস্মিত এবং আতঙ্কিত হতেই হয়। এ কাজ শুধু সংবিধানবিরোধী ও নির্বাচনী আইনবিরোধীই নয়, আমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতেই সরকার তথা রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে আলাদা করে, কেবলমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালনে সীমিত রাখা হয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষা ছাড়াও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সন্ত্রাসবাদ দমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিপর্যয়ের সময় তারা বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। এর মধ্যে দিয়েই তারা জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। কিন্তু তাই বলে তাদের কর্মকাণ্ডকে রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করা একেবারেই অনভিপ্রেত। যে ১৫৬ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক রাষ্ট্রপতির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন, তাঁরাই বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে এ ভাবে রাজনীতিতে টেনে আনা হলে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার পক্ষেও তা ক্ষতিকর।
সেনার বীরত্ব, আত্মত্যাগ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। বস্তুত প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিপদসঙ্কুল পরিবেশে লড়াই করার ক্ষমতার কারণেই নাগরিকরা সেনাবাহিনীকে সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে। তাদের এই সাহসিকতার জন্য রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রীয় সম্মানের ব্যবস্থা। কিন্তু এগুলি কখনই রাজনীতির নির্ধারক নয়। পাশাপাশি, জনতা সেনাবাহিনীকে কী চোখে দেখে, সেটাও রাজনীতির বিষয় হতে পারে না।
২০১৬ সালে উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাতের ভোটেও বিজেপি প্রচারের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল উরি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সার্জিকাল স্ট্রাইক। এ বারের নির্বাচনেও একাধিক জনসভায়, প্রকাশ্যেই বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দনের ছবি নিয়ে প্রচার চলছে। সেনাবাহিনীকে ‘মোদীজির সেনা’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করেনি।
আসলে কর্তৃত্ববাদী শাসকমাত্রই সেনাশক্তির প্রতি এক ধরনের মোহ পোষণ করেন। এই মোহের বশেই তাঁরা রাজনীতিতে সেনার ইমেজটি ব্যবহার করেন। নরেন্দ্র মোদীও এর ব্যতিক্রম নন। যে সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শে তাঁর রাজনীতির লালন-পালন, তার মধ্যেই আছে সমরবাদের প্রতি আনুগত্য। ইতিহাস কিন্তু বার বার প্রমাণ করেছে যে, শাসকের সেনা-ঘনিষ্ঠতা বা রাজনীতির সামরিকীকরণের ফল শেষে ভাল হয় না। মৃত্যু হয় গণতন্ত্রের।
জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবে এবং আলজিরিয়ার শাসক আবদেলাজ়িজ় বুতেফ্লিকারের নাম করা যায়। নিজের শাসনকে নিরঙ্কুশ করতেই মুগাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন, কিন্তু পরে সেনার বিরাগভাজন হওয়ায় কারণেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় তাঁকে। অন্য দিকে বুতেফ্লিকা সেনাবাহিনীর মদতেই ক্ষমতায় আসেন। এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর সেনার হাতের পুতুল থাকার পরে সেনাবাহিনীর হাতেই তাঁর পতন ঘটে।
গণতন্ত্রকে একটি বহুতল ভবনের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, সেটা গড়ে তুলতে একটি শক্তপোক্ত ভিত তৈরি জরুরি। সেই ভিত ভেঙে এমন সর্বনাশের রাজনীতি করলে ভারত কিন্তু সেই পাকিস্তানই হয়ে যাবে, যে পাকিস্তানকে মোদীরা এত ঘৃণা করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy