ইতিহাস: ট্রাফালগার স্কোয়ার
কৃতজ্ঞ নরওয়ের উপহার
গত দু’সপ্তাহ ধরেই নানা জায়গা থেকে ক্যারল-গায়করা ট্রাফালগার স্কোয়ার-এর বিশাল ক্রিসমাস ট্রি-এর সামনে এসে গানবাজনা করছেন। ট্রাফালগার স্কোয়ার-এর এই ক্রিসমাস ট্রি’টির একটি বিশেষ ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেন নরওয়েকে সাহায্য করেছিল। নরওয়ের রাজধানী অসলো শহরের মানুষ কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে প্রতি বছর ব্রিটেনকে একটি ক্রিসমাস ট্রি উপহার দেয়, সেটি রাখা হয় লন্ডনের এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে।
১৯৪০ সালে জার্মান সেনাবাহিনী নরওয়ে আক্রমণ করলে সে দেশের রাজা সপ্তম হাকোন ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। লন্ডনে নরওয়ে সরকারের সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই শহর থেকে নরওয়েজীয় ভাষায় যুদ্ধের খবর সম্প্রচার চলত, তার সঙ্গে সঙ্গে নরওয়েতে জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের বার্তা ও তথ্যও প্রচারিত হত।
প্রতি বছর অসলোর কাছে একটি বন থেকে এই গাছটি নির্বাচন করা হয়, বিশেষজ্ঞরা সেটি ঠিক ভাবে কেটে নেন এবং নৌকা করে ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেন। ৫০০ সাদা আলো দিয়ে গাছটি সাজানো হয়, ডিসেম্বরের প্রথম বৃহস্পতিবার থেকে আলো জ্বালানো শুরু হয়, প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন ব্রিটেনে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত। ক্রিসমাসের দ্বাদশ রাত্রিতে গাছটি নামিয়ে এনে রিসাইক্লিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। নরওয়ে থেকে প্রথম ক্রিসমাস ট্রি এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এ বছর সেই ঘটনার সত্তর বছর পূর্ণ হল।
জিশুর জন্মের আগেও
ব্রিটেনের ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, ডিসেম্বর মাসে ঘরবাড়ি সাজানোর প্রথা খ্রিস্টধর্মের অনেক আগে থেকেই এ দেশে প্রচলিত ছিল। বছরের এই সময় দীর্ঘ এবং শীতল রাত্রির মোকাবিলার জন্যই এই ধরনের সাজসজ্জা ও আলোর ব্যবহার হত।
মধ্যযুগে প্রাসাদগুলিতে ভৃত্যরা চিরসবুজ গাছ সাজাত, শীতের অন্ধকার দূর করতে আগুন জ্বালাত, ছাদ থেকে সবুজ গাছ আর লতাপাতা ঝোলানো হত, সেগুলি সাজানো হত এই সময়ের নানা ফল দিয়ে। পরে মানুষ মিস্লটো ব্যবহার করতে শুরু করে, লোকবিশ্বাস ছিল এই যে, তা সৌভাগ্য আনে, উর্বরতাও।
ডিসেম্বরে পার্টি করার রীতিও রোমান উৎসব ‘স্যাটার্নেলিয়া’ থেকে এসেছে। রোমানদের কাছে স্যাটার্ন ছিলেন কৃষি এবং প্রাচুর্যের অধিষ্ঠাতা। সমাজের সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই সময় নানা খেলাধুলো এবং প্রচুর পানাহারের মাধ্যমে সেই দেবতাকে সম্মান জানাতেন। ধনীরা দরিদ্রদের নানান জিনিস উপহার দিতেন, যাতে এই কঠিন ঋতুতে তাঁদের জীবন যাপনে কিছুটা সুবিধে হয়।
আকাশের তারা গাছে
সপরিবার: ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট
খ্রিস্টধর্মের প্রোটেস্টান্ট ধারার পথিকৃৎ মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) ছিলেন জার্মানির মানুষ। সচরাচর মনে করা হয় যে, ক্রিসমাসের সময় এক দিন আকাশে তারার মেলা দেখে তিনি ভাবেন, আলো দিয়ে গাছ সাজালে সেই সজ্জা দেখে খ্রিস্টের জন্মকালে বেথলেহেমের আকাশে তারাটির কথা মনে পড়বে, সেই ভাবনা থেকেই ফার গাছ সাজানোর রীতিটি তিনি চালু করেছিলেন। ১৮৪৩ সালের একটি ছবিতে দেখা যায়, মার্টিন লুথার সপরিবার একটি ক্রিসমাস ট্রি’কে ঘিরে বসে আছেন। তবে উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের আগেই জার্মানিতে ক্রিসমাস ট্রি-র বহুলপ্রচলন হয়েছিল, তাই ওই ছবিতে গাছটিকে দেখানোর ভাবনাটা হয়তো শিল্পীর নিজের। তবে ক্রিসমাসের আগে উপহার দেওয়ার প্রথাটির পিছনে নিশ্চয়ই মার্টিন লুথারের অবদান আছে। তার আগে ৬ ডিসেম্বর, সেন্ট নিকোলাস-এর ভোজ উপলক্ষে উপহার দেওয়া হত। সেটা পরেও চালু থাকল, কিন্তু নবজাত যিশুকে কেন্দ্র করে ক্রিসমাস উদ্যাপনের ওপর মার্টিন লুথার জোর দিলেন। ক্রমশ সেটাই উপহার দেওয়ার প্রধান উপলক্ষ হয়ে উঠল, সেন্ট নিকোলাসের সূত্র ধরে ক্রিসমাসের আগের রাত্রে শিশুদের মনোমত উপহার নিয়ে হাজির হলেন সান্তা ক্লস।
আসলে জার্মান
ক্রিসমাস ট্রি-এর ব্যবহার ব্রিটেনে আগে ছিল না। এটি এ দেশে আসে রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে, তিনি প্রিন্স অ্যালবার্টকে বিবাহ করে ইংল্যান্ডে আসার পরে। এই ঐতিহ্যটি জার্মানির। পরিবারে এই উৎসব পালনে ক্রিসমাস ট্রি-র একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। রাজপরিবারের সমস্ত কর্মীকে এই সময় বিশেষ উপহার দেওয়া হত, সেই রীতি আজও আছে। কে কত দিন কাজ করছেন, সেই অনুসারে উপহার দেওয়া হয়
সব পাঠককে জানাই মেরি ক্রিসমাস এবং হ্যাপি নিউ ইয়ার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy