Advertisement
১৯ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

খণ্ডদর্শন

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া বার্তা পাঠাইবার মাধ্যমে হিংসা ছড়াইবার খেলাটি ছেলেধরার গুজবের নিজস্ব নহে। সাম্প্রতিক কালে যতগুলি সাম্প্রদায়িক অশান্তি হইয়াছে, কার্যত তাহার প্রতিটির পিছনেই আছে এই ভুয়া বার্তা।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮ ০১:১৬
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ মন্তব্য করিয়াছেন: দেশ জুড়িয়া যে গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ড চলিতেছে, সেই ঘটনাগুলির একটি নির্দিষ্ট ছক বা ধরন আছে, সম্ভবত একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যও আছে। ইন্দিরার মতে, ঘটনাগুলি যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের বিরুদ্ধেই ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহা সমাপতন নহে। তাহাই ছক। শীর্ষ আদালত অবশ্য ইন্দিরার পর্যবেক্ষণটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে সম্মত হয় নাই। জানাইয়াছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসিয়া আসা ছেলেধরা সংক্রান্ত যে গুজব হইতে এই গণহত্যাগুলি ঘটিতেছে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ যে কোনও মানুষই এই গোত্রের হিংস্রতার শিকার হইতে পারে। ঘটনাগুলি অতএব আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন, কোনও একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংস্রতার নহে। এবং মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্র বলিয়াছেন, এই গণহত্যার ঘটনা রোধ করিবার দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলির। প্রশ্ন যে আইনশৃঙ্খলার, তাহা সংশয়াতীত। এবং এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করিতে হইলেও পুলিশি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পথে হাঁটিতে হইবে, তাহাও নিশ্চিত। সোশ্যাল মিডিয়া-বাহিত এই ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-প্রশাসনের অনেক কিছু করণীয় আছে, তাহাও অনস্বীকার্য। কিন্তু শীর্ষ আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও প্রশ্ন তোলা চলে: বিষয়টিকে শুধু আইনশৃঙ্খলার স্তরে দেখিলে তাহা খণ্ডদর্শন হইবে না কি? নিহতদের পরিচিতি সংক্রান্ত যে ইঙ্গিতটি ইন্দিরা জয়সিংহ করিয়াছেন, তাহাকে অস্বীকার করিবার তো কোনও উপায় নাই। এবং এই কথাটিও অনস্বীকার্য যে, গণপিটুনির প্রবণতা গত চার বৎসরে উল্কাগতিতে বাড়িয়াছে। অতএব, এই ঘটনাগুলিকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখাও আবশ্যক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া বার্তা পাঠাইবার মাধ্যমে হিংসা ছড়াইবার খেলাটি ছেলেধরার গুজবের নিজস্ব নহে। সাম্প্রতিক কালে যতগুলি সাম্প্রদায়িক অশান্তি হইয়াছে, কার্যত তাহার প্রতিটির পিছনেই আছে এই ভুয়া বার্তা। মানুষের মন যে ভয় পুষিয়া রাখে, সেগুলিকে উস্কাইয়া দেওয়াই এই ভুয়া বার্তার সাফল্যের মূলমন্ত্র। সোশ্যাল মিডিয়ার পথটি নূতন বটে, ভয়ের উপলক্ষ বা কারণগুলি নূতন নহে। ভিন্নধর্মাবলম্বীরা আসিয়া মহিলাদের ধর্ষণ করিবে, অথবা আপাতদৃষ্টিতে কোনও একটি নিম্নশ্রেণির লোক— সম্ভবত নিম্নবর্গেরও বটে, দরিদ্র তো বটেই— আসিয়া শিশুদের চুরি করিয়া লইয়া যাইবে, এই ভয়গুলি চিরন্তন। সেই ভয় উস্কাইতে পারিলেই দাঙ্গা ঘটে, দেশ জুড়িয়া ৩১টি গণহত্যাও ঘটে। ছকটি চেনা। আরও চেনা সোশ্যাল মিডিয়ার এই অপব্যবহারের পন্থাগুলি।

তাহারও অধিক চেনা সেই পরিবেশ, যেখানে এমন অপব্যবহার ঘটিতে পারে। দুষ্কৃতীরা জানে, কোন ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইলে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকিবে, কোন বর্ণকে পিটাইয়া মারিলেও শাস্তির ভয় থাকিবে না। মহম্মদ আখলাকের হত্যায় অভিযুক্তদের জন্য হিন্দুত্ববাদী নেতারা কোন কোন সুবিধার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, সেই সংবাদ গোপন নহে। কেন পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে, কেন নেতারা হত্যাকারীদের নির্দ্বিধায় প্রশ্রয় দিতে পারেন, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিলে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতে হইবে বর্তমান শাসকদের দিকেই। দেশের ‘প্রধান চৌকিদার’-এর দিকে। গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁহার ‘মন কি বাত’ শোনা যায় নাই। তিনি কখনও জানান নাই, একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে এই ঘটনা চলিতে পারে না। বরং, কেহ অভিযোগ করিতেই পারেন, যে তিনি প্রশ্রয় দিয়াছেন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে সার্বিক পরিবেশটি তাঁহার জমানায় তৈরি হইয়াছে, এই গণপিটুনিতে হত্যার প্রবণতা ও সাহস সেই পরিবেশেই জন্মায়। প্রশ্নটি অতএব শুধু আইনশৃঙ্খলার নহে। কেন আইনের শাসন বজায় রাখা যায় না, সেই প্রশ্নটিও, কেবল বিধেয় নহে, জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lynching social disease
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE