যথাসময় হস্তক্ষেপ করিয়া শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের ‘রক্ষাকর্তা’ হইয়া উঠিল সেই দেশের আদালত। এবং প্রায় পঞ্চাশ দিন পরে এক জন বৈধ প্রধানমন্ত্রী পাইল শ্রীলঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও নিজের মিত্রবর মাহিন্দা রাজাপক্ষকে অপসারিত করিয়া প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা কার্যত বাধ্য হইলেন পুরাতন পদাধিকারী রনিল বিক্রমসিংহেকে ফিরাইয়া আনিতে। প্রসঙ্গত, এই বিক্রমসিংহেকেই দুই মাস আগে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী পদ হইতে সরাইয়া দিয়াছিলেন। এই বারও তিনি নানাবিধ চেষ্টা করিয়াছিলেন যাহাতে বিক্রমসিংহে প্রধানমন্ত্রী না হইতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে বিক্রমসিংহেকেই শপথবাক্য পাঠ করাইতে হইল প্রেসিডেন্টকে। অক্টোবরের শেষে যখন বিক্রমসিংহেকে সরাইয়া রাজাপক্ষকে সামনে আনা হইয়াছিল, তখন রাজাপক্ষ ও সিরিসেনা দুই জনেই নিশ্চিত ছিলেন যে রাজাপক্ষ ক্রমে পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সমর্থন পাইবেন। কিন্তু তাহা ঘটে নাই। অক্টোবরের শেষ হইতে ডিসেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত কার্যত সরকারহীন দেশ চলিবার পরে নেতৃপদে ফিরিতে পারিলেন বিক্রমসিংহে। ইহাকে গণতন্ত্রের জয় বলিয়া উল্লাসে মাতিয়াছে দ্বীপরাষ্ট্রের জনসংখ্যার একাংশ। তবে এই জয় কতখানি দীর্ঘমেয়াদি, তাহা বলা কঠিন।
উল্লেখ্য, নূতন প্রধানমন্ত্রীকে শপথবাক্য পাঠ করাইবার পরই প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে তর্ক বাধিল মন্ত্রী নিয়োগ লইয়া। স্পষ্টতই সিরিসেনা নিজের সমর্থকদের ক্ষমতায় রাখিতে চাহেন, এবং বিক্রমসিংহে তাহাতে বাধা দেন। এমতাবস্থায় শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক আবহ অটুট থাকিবার আশায় বেশ খানিকটা আশঙ্কা মিশিয়া আছে, স্বীকার না করিয়া উপায় কী। যে দেশে আদালতের হস্তক্ষেপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হয়, যেখানে আইনসভার রক্ষকরূপে বিচারব্যবস্থাকে আগাইয়া আসিতে হয়, সেখানে সাংবিধানিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকিবার পথ কণ্টকশূন্য হইতে পারে না। সিরিসেনা এবং বিক্রমসিংহের সহাবস্থান সম্ভবত শান্তিপূর্ণ হইবে না। তাঁহারা একে অপরকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টায় রত থাকিবেন— এমন আশঙ্কা অমূলক নহে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করিয়া থাকেন সিরিসেনা। প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বও প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁহার হস্তেই সমর্পিত। বাস্তবিক, দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাস বলে, কার্যনির্বাহী দায়িত্বের এই হেন দ্বৈতসত্তার ফাঁসটি অতীতেও বার বার সেই দেশের প্রশাসনের কণ্ঠে চাপিয়া বসিয়াছে।
যে হেতু রাজাপক্ষ সন্দেহাতীত ভাবে চিনের পক্ষাবলম্বী, এবং বিক্রমসিংহে ভারতের— স্বভাবতই এই মুহূর্তে ঘটনার বিবর্তনে ভারত খুশি। নূতন প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় দ্বীপরাষ্ট্রে ব্যবসায়িক লগ্নির দিক দিয়া ভারত বেশ খানিকটা অগ্রসর হইতে পারিবে, এমনই আশা করিতেছে দিল্লি। তবে কিনা, একই সঙ্গে দিল্লিকে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলির দিকে সতর্ক লক্ষ রাখিয়াও চলিতে হইবে। রাজাপক্ষ ও তাঁহার সমর্থকসমাজ শ্রীলঙ্কার তামিল অধিবাসীদের প্রতি সদয় নন। বিশেষত এই বারের রাজনৈতিক পরাজয়ের পর তামিল অধিকার হরণেও তাঁহারা বিশেষ সক্রিয় হইবেন বলিয়াই আশঙ্কা। ইহার ফলে ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে আবার নূতন করিয়া চাপ পড়িবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy