প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রসবোধ কত সূক্ষ্ম, জানা নাই। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তাঁহার শাসনকালে স্থূল রসিকতায় পরিণত হইয়াছে। খাস রাজধানীতে এক কর্মনিরত মহিলা সাংবাদিকের যৌননিগ্রহ করিবার অভিযোগ উঠিল দিল্লির পুলিশের বিরুদ্ধে। অপর এক মহিলা চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরা কাড়িল পুলিশ। ওই দুই সাংবাদিকের অপরাধ, ছাত্রমিছিলের উপর পুলিশি প্রহারের সংবাদ তাঁহারা সংগ্রহ করিতেছিলেন। যে সংবাদে সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি মলিন হইতে পারে, তাহা প্রচার করিলে আঘাত নামিয়া আসিবে না? ছয় মাস পূর্বে গৌরী লঙ্কেশের গুলিবিদ্ধ দেহ কি যথেষ্ট সতর্ক করে নাই? আশ্চর্য, তাহাতেও সকল সাংবাদিক নিরস্ত হন নাই। যেমন মধ্যপ্রদেশের ভিন্ড-এর সন্দীপ শর্মা। বালি-মাফিয়ার সহিত পুলিশের সংযোগ লইয়া তিনি টেলিভিশনে খবর করিতেছিলেন। বালি বহিবার একটি ‘ডাম্পার’ সন্দীপকে পিষিয়া দিয়াছে, তাহার ছবি ধরা পড়িয়াছে নিরাপত্তা ক্যামেরায়। ইহার পূর্বেও অবৈধ বালি খননের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অন্তত তিন ব্যক্তি এমন করিয়া গাড়ি চাপা পড়িয়া মারা গিয়াছেন। মনে করিবার বিলক্ষণ হেতু আছে যে, হত্যার নকশা দিয়াই বার্তা পাঠাইতেছে হত্যাকারীরা। সন্দীপ প্রাণ হারাইবার দিনই বিহারের ভোজপুরে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারাইয়াছেন একটি হিন্দি পত্রিকার দুই সাংবাদিক। গাড়িটি এক রাজনৈতিক নেতার, তাঁহার সহিত কথা কাটাকাটি হইয়াছিল সাংবাদিকদ্বয়ের। অপ্রিয়ভাষী সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ নির্যাতন ও প্রাণনাশের হুমকি। যাহা মহিলা সাংবাদিকদের প্রতি অধিক উৎসাহে বর্ষিত হয়। গত বৎসর এক সমীক্ষায় প্রকাশ, এক সুপরিচিত মহিলা টেলিভিশন সাংবাদিক এক সপ্তাহে তিন হাজারের অধিক বিদ্বেষ-দূষিত ‘টুইট’ পাইয়াছিলেন। ইহাতে মোদীর দেশে গণতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে কী বার্তা মেলে?
সংবাদ সংগ্রহের কাজ সততই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান ভারতে সাংবাদিক-নিগ্রহ যেন এক সংগঠিত, ধারাবাহিক অপরাধ হইয়া উঠিয়াছে। তাহাতে সরকার-ঘনিষ্ঠ সঙ্ঘ পরিবারের প্রচ্ছন্ন অনুপ্রেরণার অভিযোগও কম হয় নাই। এমনকী প্রধানমন্ত্রীর দফতরও সন্দেহের বৃত্ত হইতে বাদ পড়ে নাই। সাংবাদিকদের অনলাইন হুমকি দিবার অপরাধে যাঁহারা অভিযুক্ত, তাঁহাদের সহিত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দফতর সোশ্যাল মিডিয়াতে সংযুক্ত, এই তথ্য দেশকে বিচলিত করিয়াছে। দিল্লিতে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনায় ফের সরকারের ভূমিকা লইয়া প্রশ্ন উঠিল। পুরুষ পুলিশের দ্বারা মহিলা সাংবাদিকের যৌননিগ্রহ অকল্পনীয় অপরাধ, তাহার অভিযোগের গুরুত্ব কম নহে। কিন্তু তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নিশ্চুপ রহিলেন, নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রীও বাক্যহারা। ঘটনাচক্রে দুই জনই মহিলা। দিল্লি ও মধ্যপ্রদেশ, দুইটি ঘটনাতেই তদন্তের আশ্বাস মিলিয়াছে। কিন্তু নির্যাতন-নিগ্রহের জন্য প্রেরিত কিছু ব্যক্তি ধরা যদি বা পড়ে, প্রভাবশালী প্রেরকেরা সম্মুখে আসিবে কি? সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত এখন ১৩৬তম স্থানে। আরও পিছাইবার ইঙ্গিত এখনই মিলিতেছে।
কিন্তু অন্ধকার যত ঘন হয়, আলোর শীর্ণ রেখাটিও বোধ করি তত উজ্জ্বল বলিয়া প্রতিভাত হয়। ভারতীয় গণতন্ত্র এই একটি জায়গায় এখনও আত্মশক্তিতে বলীয়ান। বাক্স্বাধীনতার এই চরম সঙ্কটে সত্যদর্শী সাংবাদিকের বক্তব্য আরও ভাস্বর হইতেছে। তাই আক্রমণও বাড়িতেছে। সংবাদমাধ্যমের অর্থনীতিতে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ করিয়াও সত্যনির্মাণের একক অধিকার ক্ষমতাসীনের হাতে আসে নাই। প্রায় প্রতিটি রাজ্যে সাংবাদিক বরখাস্ত, নিগৃহীত, নিহত হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদের অন্তত একাংশ নীরব হন নাই। সত্য বলিবার এই ভয়ানক স্বভাবের জন্যই রাজা টুনটুনিকে গিলিয়া খাইতে চাহিয়াছিল। নাক কাহার কাটিয়াছিল, মনে করাইয়া কাজ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy