একুশ শতক মিডিয়ার শতক। এই কথাটা তো আজ এক পরিচিত স্লোগান। আমরা যারা দীর্ঘ দিন ধরে মিডিয়ার মধ্যে থেকে সমঝোতা করতে করতে বড় হয়েছি, তাঁরাই যে শুধু এমনটা বলি তা নয়। আপামর সাধারণ মানুষও আজকাল এমনটাই ভাবে আর এমনটাই বলে। মিডিয়া অসম্ভবকে সম্ভব করে দেয়, মিডিয়া দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, মিডিয়া ‘কিংমেকার’, এমনটা আমিও মনে করি না। একটা সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা যতই হোক না কেন, একটা টেলিভিশন চ্যানেলের টিআরপি-ও যতই হোক না কেন, চাইলেও তারা নির্বাচনী ফলাফল সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সেটা আমাদের দেশে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সময় এমনও হয়, একটি বৃহৎ সংবাদপত্রের ব্র্যান্ড ভ্যালুর থেকে তুলনামূলক ভাবে কম পাঠকসংখ্যার একটি সংবাদপত্রের জনমতের উপর প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশি হতে পারে।
তবে জনসাধারণের একটা বড় অংশের মধ্যে শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যমের প্রভাব যে এ যুগে বিরাট ভাবে আছে, সেটা নিয়েও কিন্তু আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। জনমানসে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে বৃহৎ মিডিয়ার মধ্যে একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেই দ্বন্দ্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মিডিয়া সংস্কৃতির জটিলতা। একটি বৃহৎ সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের মালিক তাঁর কর্পোরেট বা ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখবেন, এ তো স্বাভাবিক। সেটা রুপার্ট মার্ডক বা সিলভিও বার্লুস্কোনি হোন আর ভারতীয় মালিক সমীর জৈন বা সুভাষ চন্দ্রই হোন। কিন্তু এই প্রচারমাধ্যমের জনপ্রিয়তা কর্পোরেট স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারে না। এই নিশ্চয়তাটা কিন্তু দেয় সাধারণ মানুষ। ফলে কর্পোরেট পুঁজি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করলেও তাকে কিন্তু জনমুখীও হতে হয়। আর এখানেই মিডিয়া সংস্কৃতির জটিলতা।
সাধারণ মানুষের মধ্যে শাসক দল বা নেতানেত্রী সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে একটা ‘পারসেপশন’ তৈরি হয়। ‘পারসেপশন’ অনেক সময় এতটাই শিকড় বিস্তার করে যে অতীতের ভাবমূর্তি বদলে কোনও ব্যক্তি বা দল যদি নতুন পথেও চলে, তা হলেও বহু মানুষের কাছে সেই অতীতের ধারণাটাই মস্তিষ্কের মধ্যে গেঁথে থাকে। লন্ডনে আমার বন্ধু তীর্থঙ্কর প্রায় দু’দশক আগে বিবিসি-তে চাকরি করত। বহু বছর আগে বিবিসি ছেড়ে দিয়ে সে অন্য একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছে। এখনও তাঁকে আমরা সবাই ভুল করে বিবিসি-র তীর্থঙ্কর বলে ফেলি। এই ছোট্ট উদাহরণটি থেকে আপনারা বুঝতে পারেন যে মিডিয়ার তৈরি করা ‘পারসেপশন’ বদলানোটাও অনেক সময় কত কঠিন হয়ে পড়ে।
মিডিয়া একটি সম্মতি নির্মাণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। একে বলা হয়, ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট। গণতান্ত্রিক দেশে শুধু ভোটের সময় নয়, গোটা বছর ধরেই মিডিয়া এই মধ্যস্থতার কাজ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর সিংহ মিডিয়া সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘কমিউনিকেটিং ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার (১৯৯৯)’-এ দেখিয়েছেন, মিডিয়া কী ভাবে শুধু তথ্য সংগ্রহ এবং শুধু প্রযুক্তির ব্যাপার নয়, মিডিয়ার সম্প্রসারণ যে ভাবে আমাদের সমাজে হচ্ছে, তাতে সমাজের মধ্যে মিডিয়া একটা সাংস্কৃতিক সমতা নিয়ে আসছে। সেখানে বিত্তশালী ও বিত্তহীনের ফারাক ধরা পড়ে না। উচ্চ বনাম গণ বা নিম্ন সংস্কৃতির বিতর্ককে নয়া মোড় দেয়। আর সেই মিডিয়া সংস্কৃতি এক বিচিত্র সার্বভৌমত্বের জন্ম দিচ্ছে, যাকে বলা যায় অক্ষমের সার্বভৌমত্ব।
আপনারা পিপলি লাইভ ছবিটা দেখেছেন?
আমার তো মনে হয় এই ছবিটি সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাস-এ রাখা যায়। আমির খান প্রযোজিত এই ছবিটি দেখলে বোঝা যায়, গ্রামীণ সত্যকে কী ভাবে মিডিয়া-র তৈরি করা সত্য নিয়ন্ত্রণ করছে। বিখ্যাত বাঙালি গায়ক ক্লান্ত হয়ে হিমালয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন একাকীত্বের সাধনায়। তার পর সেখান থেকে মোবাইল ফোনে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে তাঁর ভক্তদের জানাচ্ছেন, তিনি হিমালয়ে একাকীত্বের সাধনাটা ঠিক কী ভাবে করছেন, কী খাচ্ছেন, কী বই পড়ছেন। তাঁর সারা দিনের রোজনামচাটা তিনি জানাচ্ছেন।
শাসক দল মিডিয়ার দ্বারস্থ। বিরোধী দল মিডিয়ার দ্বারস্থ। আর সর্বগ্রাসী মিডিয়া এই ভ্রমের শিকার যে তারাই দেশ চালাচ্ছে!
হায় রে! এ দেশে পিঁপড়ের মতো কোটি কোটি সাধারণ মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy