ভারতের জনপ্রতিনিধিরা সংসদ অচল রাখিবার যে অতি উত্তম বন্দোবস্ত বাহির করিয়া ফেলিয়াছেন, তাহা হইতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উদ্ধার করিবার দায়টি শেষ পর্যন্ত কাহার? যে বিরোধীরা অধিবেশন শুরু হইবার সঙ্গে সঙ্গে হইহট্টগোল শুরু করিয়া দিতেছেন, ওয়েল-এ নামিয়া গলা ফাটাইতেছেন, তাঁহাদের? না কি, যে সরকার পক্ষ বহু অনুরোধ উপরোধ দাবিদাওয়া সত্ত্বেও বিরোধীদের বক্তব্য লইয়া আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছেন না, তাঁহাদের? রাজ্যসভার বিরোধী নেতা গুলাম নবি আজাদ বলিয়া দিয়াছেন, অচলাবস্থার জন্য দায়ী বিজেপি। বিরোধীরা চাহিলেও সংসদীয় কার্যক্রম স্বাভাবিকতায় ফিরাইবার চেষ্টা হইতেছে না। বিপরীতে, রাজ্যসভার সভাপতি বেঙ্কাইয়া নায়ডু-র বক্তব্য, বিরোধীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই হতভাগ্য সংসদের এই অবস্থা। তাঁহার আপাত-আহত বিস্ময় মর্মস্পর্শী: ইহা কি সংসদ, না অন্য কিছু? দায়িত্ব বিষয়ক দুই পক্ষের চাপান-উতোরটিও অবশ্য গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা তৈরিরই আর একটি অধ্যায়। একটি কথা এই অবকাশে মনে করাইয়া দেওয়া ভাল। গত দশ বৎসরের ইতিহাস কিন্তু কোনও ভাবেই এনডিএ কিংবা ইউপিএ কাহাকেও এ বিষয়ে কম অপরাধী ঠাহরিতে পারে না, কেননা দুই পক্ষের শাসনেই বিরোধীরা একই রকম গোলযোগ ও নৈরাজ্য সৃষ্টির দক্ষতা দেখাইয়াছেন। ইউপিএ-র দ্বিতীয় পর্বের শাসনে কোনও একটি সংসদ অধিবেশনও স্বাভাবিক ভাবে ঘটিতে পারে নাই, বিজেপি-নেতৃত্বে বিরোধীরা তখন এমনই উদ্দাম ‘সক্রিয়’ হইয়া পড়িতেন। একই ভাবে, ২০১৮ সালের এনডিএ সরকারের বিরোধীরাও দেখাইয়া দিতেছেন যে, সংসদের মতো মর্যাদাময় প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় প্রতিরোধ কোন অতলে পৌঁছাইতে পারে।
চলতি অধিবেশনে ৫ মার্চ হইতে এক দিনও সুস্থ আলাপ-আলোচনা হয় নাই, অর্থাৎ একাদিক্রমে ১৩টি সংসদীয় কর্মদিবস নষ্ট হইয়াছে। ২০০৯ সালের পর আর কোনও বৎসরের বাজেট অধিবেশনে এই পরিমাণ সময় নষ্ট হইবার দৃষ্টান্ত নাই, কাজের এতগুলি ঘণ্টা বানে ভাসিয়া যায় নাই। টিডিপি, টিআরএস, এআইএডিএমকে দলসমূহ নিজেদের কৃতিত্বে গৌরবান্বিত বোধ করিতে পারে। অর্থ বিল বিনা আলোচনায় পাশ হইয়াছে। তিনটি অনাস্থা প্রস্তাব পড়িয়া আছে, বিতর্ক আহ্বানের পরিবেশ পাওয়া যায় নাই। কাজকর্ম বন্ধ দেখিয়া সভাপতি নায়ডু নৈশাহারের আমন্ত্রণও বাতিল করিয়াছেন। সব মিলাইয়া, সংসদে যাহা ঘটিতেছে, বিদ্যালয়েও তেমন ঘটে না। কেননা, বিদ্যালয়গুলিতে দায়িত্ব লইবার মতো ব্যক্তি থাকেন। সংসদে থাকেন না।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী বা স্পিকারের কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকেই। কোন উপায়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশকে আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা করা যায়, প্রাত্যহিক চাপান-উতোরের উপরে উঠিয়া সে-কথা তাঁহাদের ভাবা উচিত ছিল। কংগ্রেস রব তুলিতেছে, দেশের এত বড় দুর্নীতির সময়েও দেশের ‘চৌকিদার’ কেন মুখ খুলিতেছেন না। বাস্তবিক, প্রধানমন্ত্রীর নিজের কিছু মন্তব্য এই সময়ে জরুরি ছিল— নীরব মোদী কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা, কিংবা টিডিপি-র মতো বৃহৎ শরিক দলের সমর্থন উঠাইয়া লইবার মতো ঘটনা তো রোজ ঘটে না। পরিস্থিতির গুরুত্বই দাবি করে, সরকার পক্ষের অধিক দায়িত্ব গ্রহণ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রাথমিক দাবি ছিল, সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক। অথচ ব্যক্তিগত স্তরে, জন-প্রতিনিধিরা এখন প্রতিনিধিত্ব বলিতে বোঝেন ক্ষমতা, দায়িত্ব বস্তুটি তাঁহাদের চিন্তাজগতের বাহিরে। আর দলগত স্তরে, যত কম পারস্পরিক বিনিময়, ততই অন্যকে দোষ দিবার সুবিধা, তাই দায়িত্ব লইতে কেহ রাজি নন। এমনই চমৎকারী দাঁড়াইয়াছে দেশের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিসভার চেহারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy