Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মা আমার হাম্বা ডাকে

পণ্ডিতগুলো কি সত্যিই গামবাট, না কি জাস্ট হাততালির লোভে হরেন্ডাস হাবিজাবি বকতে থাকে? বলছে, ছাগলের মাংস যদি খাওয়া যায়,তা হলে গরুর মাংস খাওয়া যাবে না কেন? ছাগলও প্রাণী, গরুও প্রাণী। আরে! সে তো মানুষও প্রাণী। তাইলে মানুষ মেরে খাস না কেন? ক্যানিবালবাদ নিষিদ্ধ কেন? মানুষকে আত্মীয় ভাবিস বলেই তো? গরু আমাদের মা রে পাগলা।

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

পণ্ডিতগুলো কি সত্যিই গামবাট, না কি জাস্ট হাততালির লোভে হরেন্ডাস হাবিজাবি বকতে থাকে? বলছে, ছাগলের মাংস যদি খাওয়া যায়,তা হলে গরুর মাংস খাওয়া যাবে না কেন? ছাগলও প্রাণী, গরুও প্রাণী। আরে! সে তো মানুষও প্রাণী। তাইলে মানুষ মেরে খাস না কেন? ক্যানিবালবাদ নিষিদ্ধ কেন? মানুষকে আত্মীয় ভাবিস বলেই তো? গরু আমাদের মা রে পাগলা। মা’কে কেউ কেটে খেতে পারে? গেঁড়ে পণ্ডিত জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘কে বলল, গরু আমাদের মা?’ কে আবার, ধর্মগুরুরা। ওঁরা বালিশের বদলে শাস্ত্রে মাথা দিয়ে ঘুমোন, আখরোট ভাঙতে এ-হাতে উপনিষদ ও-হাতে মনুসংহিতা নিয়ে চটাস। এ বার গোঁয়ার গাধা প্রশ্ন করতে পারে, ধর্মগুরুরা যে সব জানেন, তা কে বললে? হাহা, উত্তরটা আরও সোজা। সব জানেন বলেই তো তাঁরা ধর্মগুরু, আর তুই নোস।

ওরে ভাই, ভারত একটা হিন্দু দেশ। কারণ, এই দেশের বেশির ভাগ লোক হিন্দু। তাই এই দেশের নাম হিন্দুস্তান। তা হলে, এখানে থাকতে গেলে, হিন্দুদের কথা মেনে চলতে হবে। এ তো অংক। পাতিগণিত। এখানে তো কোনও ঝাপসাবাজি নেই। কে বা কারা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে একটা আচাভুয়া শব্দ লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে, আর ক’টা আঁতেল তাতে চার্জ খেয়ে ‘আমরা কোনও ধর্মকেই প্রাধান্য দেব না’ বলে লম্ফ মারছে, তাতে তো আর ভারতের আত্মা বদলে যায় না রে বাবা। বড় বড় মহাপুরুষ বলে গেছেন, ভারতকে বুঝতে গেলে ধর্ম দিয়েই বুঝতে হবে। এক একটা দেশের এক একটা জোরের জায়গা। রাশিয়াকে চিনতে গেলে, বিপ্লব। জাপানকে চিনতে গেলে, ডিসিপ্লিন। জার্মানিকে, জেদ। তেমনি ভারতকে চিনতে গেলে তোমায় জানতে হবে, এই সেই দেশ, যেখানে দাড়িওলা জটাজুটধারী মুনিঋষিরা গাছের তলায় বসে সারা দিন সিধে শিরদাঁড়ায় ধ্যান বাগাতেন আর অউম বলে গর্জন করতেন, তার পর হঠাৎ কী যেন ভেবে পেয়ে পুঁথিটি সড়াৎ বের করে পাতার পর পাতা এমন ফিলসফি লিখে ফেলতেন যার প্রতিটি শ্লোক প্রশ্নাতীত ভাবে সত্যি আর তর্কাতীত ভাবে অনুসরণীয়। সেগুলোর সামারি হল: নিষ্ঠা ভরে পুজো করো, মুসলিম দেখলেই ধোলাই দাও, আর, গরু খেয়ো না। যদি বলো, এইটুকু বোঝাতে অত পাতার পর পাতা লিখতে হল কেন, তা হলে জিজ্ঞেস করব, একটা আপেল গাছ থেকে নীচের দিকে পড়ে, এইটুকু বোঝাতে একটা লোককে এতগুলো সূত্রটুত্র প্রণয়ন করে হাঁইহাঁই হালুমগিরি করতে হল কেন?

কথাটা খুব সোজা। মা’কে অপমান তো সবচেয়ে বড় অপমান? মা তুলে কথা বললে তো চড়-ঘুসি নিয়ে লাফিয়ে পড়তেই হয়? তা, আমাদের মা’কে যদি কেউ মার্ডার করে, তাকে আমরা খুন করব না? পণ্ডিতরা চাকরি রাখার জন্যে ভুজুংভাজুং–এর চাষ করে, ঝগড়া করতে এত ভালবাসে যে তক্কোবাজির স্বার্থে সব সহজ বোধকে ভাসান দেয়, কিন্তু সে ছাড়া সব্বাই নির্ঘাত স্বীকার করবে, মা আমাদের সবচেয়ে ভালবাসার ধন, সবচেয়ে প্রণামের ঐশ্বর্য। মা’র দুধ নিয়ে আমরা ডেলি কা ডেলি কোঁতকোঁত করে গিলব, বাছুরকে অভুক্ত রাখব, ঠিক আছে। মা’কে দিয়ে গাড়ি টানাব আর তাতে তুলে দেব টন টন খড়ের বোঝা, ঠিক আছে। মা’কে দিয়ে লাঙল টানাব আর বেগড়বাঁই দেখলে ল্যাজ মুচড়ে পিঠে পাঁচন পিটিয়ে পথে আনব, ঠিক আছে। মা’র চামড়া ছাড়িয়ে যে জুতো তৈরি হবে তা দাবড়ে পরব, যে ব্যাগ তৈরি হবে তা কাঁধে নেব স্টাইল মেরে, যে জ্যাকেট তৈরি হবে তা লড়িয়ে ইগো বাড়াব, যে বেল্ট তৈরি হবে তা কোমরে আচ্ছাসে প্যাঁচাব। কিন্তু মা’র মাংস যে খাবে, তাকে শেষ করে দেব। সিধে কথা। কেউ বলতে পারে, তবে মা’কে প্রথম থেকেই পেন্নাম ঠুকে যত্নআত্তি করে তুলোর বাক্সে রাখছ না কেন বাবা? গরুকে সারা দিন খেয়েদেয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনন্ত স্বাধীনতা কেন দিচ্ছ না? তাকে পিষে নিংড়ে শুষে নিজের কাজে লাগিয়ে নিচ্ছ কেন? বাঃ, মা হবে, আর সংসারের কাজে, সন্তানদের সেবায়, উন্মাদের মতো খাটবে না? আমাদের রিয়েল মা আমাদের কাপড় কেচে রান্না করে খাবার বেড়ে ঘর নিকিয়ে উঠোন ঝেঁটিয়ে বাসন মেজে মাথা টিপে তার পর মুখঝামটা খেয়ে শুতে যাচ্ছে না দৈনিক বেসিসে? তা হলে? গরু আমাদের মা, আমরা তাকে ছিবড়ে করে নেব, তার পর সে মরে গেলে যদি কেউ তার মাংস খায়, তাকে পিটিয়ে মাতৃভক্তি দেখাব। কারণ এটাই হয়ে আসছে। আর, যা হয়ে আসছে, তা-ই হয়ে চলা উচিত, এ তো সক্কলেই মানবে। তা নইলে তো বাথরুমে ভাত খাওয়া হত, আর বিছনায় সারা হত ওয়াক-থু!

একটা লোক তার ফ্রিজে গোমাংস রেখেছে যদি সন্দেহ হয়, অবশ্যই খুন করব। একটা লোক গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ হলেই, মার। গরুকে মেরেছে, সন্দেহ হলে, ন্যাংটো করে গ্রামে ঘোরাব, তার পর গাড়ির সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক চাবকাব। পরে যদি দেখা যায়, আসলে একটা সিংহ গরুটাকে মেরেছিল, কিছু এসে যায় না। সিংহকে তো আর পেটানো যায় না, নিজে ঝাড় খেয়ে যাওয়ার চান্স আছে। ফের বলি, গরু আমাদের মা। দেশ আমাদের মা। ধর্ম আমাদের মা। মানে, ধর্ম আমাদের গরু। ইয়ে, গুলিয়ে গেছে। বলতে চাইছি, গরুতে ভরা দেশ, পেটানির ইচ্ছেয় ভরা ধর্ম। উঁহু, লাঠি আমাদের ধর্ম, গো-রক্ষার ছুতোয় ধর্ষকাম আমাদের নেশা, মস্তানি আমাদের পেশা, হিন্দু চৌখুপ্পি আমাদের দেশ। আরে না না, শক্ত স্যান্‌স্ক্রিট তো মুখস্থ থাকে না, তাইলে সুবিধে হত, আসল থিম হল, ধর্ম আমাদের দিয়েছে অন্য মানুষকে বেমক্কা পেটাবার অধিকার, আর তা তারিয়ে ভোগ করতে করতে এমন মৌতাত চড়ে গেছে যে কক্ষনও গরুর পোস্টার ছাড়ব না, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক। গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, অনেকে ব্যঙ্গ করে: পড়াশোনা নেই। বাপ আমার, দুলে দুলে পড়াশোনা করতে গেলে, পেটানির সময় কম পড়ে যাবে যে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE