Advertisement
০২ জুন ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সিন্ধুদর্শন

আমেরিকার সোশ্যাল মিডিয়ায় #মি টু আন্দোলনের হাত ধরিয়া যাহার সূত্রপাত, তাহা তো কবেই সেই দেশের গণ্ডি ছাড়াইয়া আন্তর্জাতিক রূপ পাইয়াছে

#মিটু আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র।

#মিটু আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র।

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ছোট ছোট বিন্দু মিলিয়াই তো সিন্ধু তৈরি হয়। তেমনই বিচ্ছিন্ন, প্রায় অশ্রুত স্বরগুলি যখন কোনও শক্ত জমিতে জমা হইতে থাকে, এক সময় তাহা সমুদ্রের শক্তি অর্জন করে। কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন সেই সমুদ্রশক্তিই অর্জন করিবার পথে। আমেরিকার সোশ্যাল মিডিয়ায় #মি টু আন্দোলনের হাত ধরিয়া যাহার সূত্রপাত, তাহা তো কবেই সেই দেশের গণ্ডি ছাড়াইয়া আন্তর্জাতিক রূপ পাইয়াছে। সেপ্টেম্বর হইতে প্যারিসে শুরু হওয়া ‘নু-তুত’ আন্দোলনও তো শুধু ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই। প্রায় সমগ্র ইউরোপ তাহাতে শামিল হইয়াছে। এবং শুধুমাত্র অংশগ্রহণ নহে। প্রতিবাদকে তাহার অনায়াস বিচরণক্ষেত্র নেটদুনিয়া হইতে সরাসরি পথে নামাইয়াছে। গত ২৫ নভেম্বর ইউরোপের বিভিন্ন শহরে মিছিল করিয়াছেন প্রতিবাদীরা। শুধুমাত্র প্যারিসেই সেই সংখ্যা ত্রিশ হাজার ছুঁইয়াছিল। পোস্টার ধরা হাতে, সাদা পোশাক পরা শরীরে, মুখোশ ঢাকা মুখগুলিতে প্রকট হইয়াছিল একটাই দাবি, লিঙ্গ-হিংসা বন্ধ হউক। ২৫ নভেম্বরকে রাষ্ট্রপুঞ্জ যে ঘোষণা করিয়াছে নারী নির্যাতন রুখিবার আন্তর্জাতিক দিন হিসাবে।

কিন্তু লিঙ্গ-হিংসা তো নূতন নহে। গৃহমধ্যে নারী নির্যাতন যেমন যুগ যুগ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে, তেমনই গৃহের বাহিরে নারী যখনই পা রাখিল, নির্যাতন তখন হইতেই তাহার সঙ্গী। নির্যাতন কেবল শারীরিক নহে, মানসিকও বটে। নারী শুধুমাত্র অন্দরমহলে আবদ্ধ থাকিবে না, ক্রমাগত আত্মত্যাগের মাধ্যমে সন্তান প্রতিপালন করিবে না, বাড়ির পুরুষদের জন্য ভাত রাঁধিবে না, বরং কর্মস্থলে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধ মিলাইয়া কাজ করিবে, স্বাধীন ভাবে উপার্জন করিবে— পুরুষতন্ত্র ইহা মানিয়া লইবে কী প্রকারে! মেধা এবং সক্ষমতার বিচারে তাহাদের দমাইতে না পারিলে, হাতে পড়িয়া থাকে নির্যাতন। কিন্তু এত দিন সেই নির্যাতনের কাহিনি এমন তীব্র ভাবে প্রকাশ পায় নাই। তাহা যে প্রকাশ করিবার জিনিস, তাহাও অনেক নির্যাতিতাই জানিতেন না। তাঁহারা জানিতেন, নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করা, অথবা অ-সহ্য হইলে কর্মস্থলটি ত্যাগ করাই নিয়তি।

এই ভয়টিই কাটাইয়া উঠিবার পথ দেখাইয়াছে সোশ্যাল মিডিয়া। বস্তুত, সোশ্যাল মিডিয়াই সেই শক্ত জমিটির সন্ধান দিয়াছে, যাহাতে দাঁড়াইয়া সে কর্মক্ষেত্রে এ হেন বৈষম্য এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে গলা তুলিতে পারে। এবং সঙ্গে পাইতে পারে ঠিক তাহারই মতো আরও কিছু কণ্ঠস্বরকে। একলা স্বরকে ধমকাইয়া রাখা সহজ। কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ স্বর সেই ধমককে ডরায় না। বরং আরও সঙ্গী খুঁজিয়া স্ব-ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করিতে সে সর্বদাই তৎপর। #মি টু আজ তাই কোনও এক জন নবীন নায়িকার অভিজ্ঞতা নহে, কোনও এক সাংবাদিকেরও অভিজ্ঞতা নহে, তাহা সার্বিক ভাবে সমগ্র নারীসমাজের অভিজ্ঞতার গল্প। এবং লিঙ্গ-হিংসার বিরুদ্ধে নারী সমাজের পক্ষ হইতে এক সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক। অন্তর্জালের আড়ালে থাকিয়া লড়াই নহে। পথে নামিয়া, সব ধর্ম, সব দেশ, সব স্তরের প্রতিবাদী নারী-পুরুষকে একত্রিত করিয়া সেই বিশেষ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাটির বিরুদ্ধে লড়াই। ২৫ নভেম্বরের ইউরোপ সেই লড়াইয়েরই আনুষ্ঠানিক সূচনা করিয়াছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE