দিবসগুলো পালিত হয়, শপথগুলো নয়— পরিচিত বাক্যবন্ধটা আবার নিজের প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পেল। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকী সাড়ম্বরে পালিত হল গোটা দেশে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন তারুণ্যের উদ্দেশে। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ যে কালোত্তীর্ণ এবং আজকের ভারতের জন্যও যে তা সমান প্রাসঙ্গিক, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ওই পরিচিত বাক্যবন্ধটা গোটা জাতির মানসপটে উঁকি দিল।
শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বছরে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করছেন, আজকের যুগেও স্বামীজির বাণী তথা জীবনাদর্শ কতটা প্রাসঙ্গিক— এর মধ্যে নেতিবাচক কিছু নেই, আদ্যন্ত ইতিবাচকই বরং। নরেন্দ্র মোদী যথার্থ ভূমিকাই পালন করেছেন এ ক্ষেত্রে। কিন্তু মোদীর এই বার্তা জাতীয় জীবনে ফলিত প্রয়োগের জন্য, নাকি শুধু কথকতার জন্য, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
১৮৯৩ সালে শিকাগোয় আয়োজিত ধর্ম মহাসম্মেলনে শুধু হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্ব কিন্তু করেননি স্বামী বিবেকানন্দ, করেছিলেন ভারতীয়ত্বের প্রতিনিধিত্ব। ভারতের অপরিসীম সহিষ্ণুতা আর সমগ্র বিশ্বের প্রতি অপার আত্মীয়তাই ছিল বিবেকানন্দের ভাষণের অন্যতম মূল উপজীব্য। এমন এক সহিষ্ণু জাতির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গর্বিত— বিশ্বকে বলেছিলেন তরুণ ভারতীয় সন্ন্যাসী। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামির বিপদ ব্যাখ্যা করেছিলেন। সম্প্রীতির অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: সেই নরেন্দ্রর ভাষণ আজ হাতিয়ার হল এই নরেন্দ্রর
আজকের ভারতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক স্বামীজির সেই ভাষণ। তীব্র অসহিষ্ণুতার আবর্ত আজকের ভারতে ঝড় তুলে দিয়েছে। গোমাংস বিরোধিতার নামে একের পর এক আক্রমণ নামছে মানবতার উপরে। দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গি, লঙ্কেশরা খুন হচ্ছেন। কখনও আক্রমণকারী, কখনও শরণার্থী রূপে এ ভূখণ্ডে পা রাখা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে যুগে যুগে উদার বক্ষে আশ্রয় দিতে অভ্যস্ত যে দেশ, সেই দেশের সরকার আজ নিরাশ্রয়, বিপন্ন রোহিঙ্গাদের গণ-বহিষ্কারের নীতি নিচ্ছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার কথা মনে করিয়ে দেন, যখন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ অনুসরণের পরামর্শ দেন, তখন আশার স্ফূলিঙ্গ তৈরি হয় বই কি! কিন্তু পরক্ষণেই সে স্ফূলিঙ্গ নিভে যায়। মনে পড়ে যায়, ভারতের এই অসহিষ্ণুতার আবহ কাদের প্রশ্রয়ে জমাট হচ্ছে।
শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকীতে নরেন্দ্র মোদী যে বার্তা দিলেন, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বার্তা এটাই। কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের গুচ্ছ দৃষ্টান্ত ভরসা রাখতে দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা কি শুধু এই নির্দিষ্ট দিনটার জন্যই? নাকি এই দিনটা মাহাত্ম্যে উজ্জ্বল যে শপথকে ঘিরে, সেই শপথের প্রতিও সমানভাবে দায়বদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক কারণেই মাথা তুলছে। জবাব অচিরেই মিলবে, সংশয় নেই। কিন্তু জবাবটা ইতিবাচক হবে, না নেতিবাচক, ধন্দ রয়েছে তা নিয়েই। সমগ্র জাতি যে ইতিবাচক জবাবের অপেক্ষাতেই রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর ধন্দ থাকা উচিত নয়। অতএব, শুধু দিবস উদ্যাপনে নয়, শপথ পালনেও প্রধানমন্ত্রী সমানভাবে গুরুত্ব দেবেন বলে আমরা ধরে নিচ্ছি। বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়া বা না দেওয়ার দায় এখন প্রধানমন্ত্রীরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy