Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মা মানে যিনি কেবল আত্মত্যাগ করে যাবেন

সুপারস্টারের ঝকমারি

নাজমাকে আমাদের এত মনে ধরে, কারণ আমরা বিশ্বাস করি মাতৃত্বই মেয়ে-জীবনের একমাত্র সার্থকতা। মেয়ে জন্মালেই আমরা ধরে নিই ভবিষ্যৎ মায়ের জন্ম হল।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দুটি মেয়ের গল্প ‘সিক্রেট সুপারস্টার’। একটি মেয়ে পঞ্চদশী গায়িকা, নাম ইনসু। প্রাথমিক ভাবে মনে হয় ছবিটি ইনসুকে ঘিরে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আসল সুপারস্টার ইনসুর মা, মধ্যবয়সি, স্বল্পশিক্ষিত, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার নাজমা। নাজমা সুপারস্টার, কারণ নাজমা এক জন আত্মত্যাগী মা! নাজমা স্বামীর মারে রক্তাক্ত হয়, কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করে, কারণ সে মা। আবার ছবির শেষে নাজমা আচম্বিতে ঘুরে দাঁড়ায়, স্বামীকে ত্যাগ করে, কারণ তার মেয়ে ইনসুর প্রাণ গিটারকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে বলে স্বামী, এবং নাজমা জানে, গিটার ছাড়া ইনসু বাঁচবে না। অর্থাৎ তার নির্যাতন সহ্য করা এবং ঘুরে দাঁড়ানো দুইই প্রধানত সন্তানের জন্য। নাজমার কিছুই নিজের জন্য নয়, কারণ সে মা। ছবির শেষেও দু’লাইন সব মায়েদের এবং মাতৃত্বের জয়গান গাওয়া হয়। আমরা, দর্শকরা, জামার খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে কফি খাই। আর ভাবি, আহা, কী দারুণ মা এই নাজমা। সব মেয়ের নাজমার মতো মা হয়ে ওঠা দরকার। বাড়ি ফিরে নিজের মেয়েকে, বোনকে, ভাগ্নি, ভাইঝিকে ওই নাজমার মতো মা হয়ে ওঠার পরামর্শ দিই এবং চার পাশে মেয়েরা কতখানি উপযুক্ত মা হয়ে উঠছেন, নিক্তিতে মাপতে থাকি।

নাজমাকে আমাদের এত মনে ধরে, কারণ আমরা বিশ্বাস করি মাতৃত্বই মেয়ে-জীবনের একমাত্র সার্থকতা। মেয়ে জন্মালেই আমরা ধরে নিই ভবিষ্যৎ মায়ের জন্ম হল। কাঁথায়-শোয়া মেয়েকে আদর করে ডাকা হয়, ‘মা’। কিছু দিন আগে পর্যন্ত মেয়েদের জন্য চালু আশীর্বাণী ছিল, ‘শত পুত্রের জননী হও’। অনেক সময়ই সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার পর মেয়েদের আর নাম ধরে ডাকা হয় না, অমুকের মা, তমুকের মা-ই হয়ে যায় তার পরিচয়। স্কুলের দিদিমণি ছাত্রছাত্রীর মাকে অমুকের মা ডাকতেই অভ্যস্ত, বাড়ির কাজে সহায়িকাকে আমরা অনেক সময় অমুকের মা ডাকি, পাশের বাড়ির প্রতিবেশিনীও মা হওয়া মাত্র অমুকের বউ থেকে তমুকের মা’তে পরিণত হন। এই মা ডাক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমিত থাকে না। দেশের মন্ত্রী থেকে ধর্মগুরু সবাই ভাষণের শুরুতে ‘মা-বোনেরা’ বলে ভাষণ শুরু করেন। আশ্চর্যজনক ভাবে মেয়েরা কারও ‘মিত্রোঁ’ অথবা ‘বন্ধুগণ’ নয়। বহু সরকারি প্রকল্পে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় মেয়েদের স্বনির্ভর দলকে ‘মায়েদের’ দল বলা হয়। অনেক সময়েই সে সব দলের সবাই মা নয়, তবুও সে দলের নাম মায়েদের দল, ধরেই নেওয়া হয়, মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে, এক দিন না এক দিন সে মা হবেই। উহ্য কথাটি হল, মেয়েদের মা হতে চাওয়া অথবা না চাওয়ার মধ্যে নিজের সিদ্ধান্তের কোনও জায়গা নেই। মেয়ে জন্ম মানেই মা-জন্ম। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় বাচ্চাদের খাবার রাখার একটি গোডাউন ছিল। সেই গোডাউন দেখভালের দায়িত্বে ছিল একটি মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীর মেয়েদের বলা হত, গোডাউন-এর মা।

কেন মেয়েদের সারাক্ষণ মা-মা করা হয়, কেন পরিবারে, সমাজে, সিনেমা-নাটকে, গানে, কবিতায় মাতৃত্বকে এত মহিমান্বিত করা হয়, সেটা একটু খতিয়ে দেখা যাক। মা আসলে কী করে? শুধু কি শিশুর জন্ম দেয়? সে তো দেয়ই। তার সঙ্গে শিশুকে বড় করার মূল দায়িত্ব মায়ের। ঠিকই, শিশুর জন্ম দিতে একটি জরায়ু লাগে, কিন্তু তার পর? তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়া আর সব কাজ দুটো হাত দিয়েই হয়। শিশুর দেখাশোনা করা, পরিষ্কার রাখা, কাঁথা কাচা, একটু বড় হলে তার রান্না করা, হোমওয়ার্ক করানো, খেলাধুলা, নাচগানের ইস্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো জরায়ু লাগে না। এ সব কাজের জন্য দুটো হাত আর ধৈর্য লাগে, আর তা যেমন মায়ের আছে, তেমনই বাবারও আছে। তবুও বাচ্চাকে বড় করে তোলার খাটুনি মায়ের ঘাড়েই চাপে। আর মা যাতে এ দায় খুশি মনে পালন করেন সে জন্যই সমাজে মায়ের ভূমিকাকে এত গৌরবান্বিত করা হয়, চার পাশে মায়ের এত জয়গান গাওয়া হয়, সিনেমায় নাজমার মতো চরিত্র সৃষ্টি হয়।

এ আসলে এক বৃহত্তর রাজনীতির খেলা। যে রাজনীতিতে মেয়েদের ছোটবেলা থেকে অষ্টপ্রহর সংসারের জোয়াল টানতে শেখানো হয়। মা মানে অষ্টপ্রহর সন্তান এবং সংসারের সেবায় নিবেদিত। সন্তান এবং গুষ্টির সক্কলের সুখসুবিধার দায়িত্ব মায়ের। আর মেয়েদের এই মা হয়ে ওঠার নেট প্র্যাকটিস শুরু হয় বালিকাবেলা থেকেই। কোন ছোটবেলা থেকে মেয়েরা ছোট ভাইবোনের দেখভাল করে। আট-দশ বছরের দিদির কাছে ভাইবোন রেখে মা-বাবা অনায়াসে কাজে যায়। সেই টেপজামা-পরা বয়স থেকে বাচ্চা সামলাতে সামলাতে এই দিদিরা নিজের অজান্তেই কখন যেন মা হয়ে ওঠে। ফলে জীবনে যখন সত্যিই মায়ের খাটুনি খাটার সময় আসে, তখন তাদের মনে হয়, এ-ই তো স্বাভাবিক!

শুধু ঘরের কাজেই এ রাজনীতি সীমিত নয়। মাঠের কাজ থেকে কর্পোরেট, সব ধরনের কাজেই মায়েদের এখন অবাধ যাতায়াত। কিন্তু সেখানেও মায়ের রেহাই নেই। মা যদি চাকরি করে টাকা রোজগার করেন, তা হলে সে টাকার সিংহভাগ সন্তানের জন্য খরচ করতে হবে এবং সারা দিন বাড়িতে না থাকার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে হবে। আপিসের পর যদি মা-জননী বন্ধুদের সঙ্গে এক পাত্তর কফি খেয়ে বাড়ি ঢোকেন, সে মা রাক্ষসী-মা। আজকাল অনেক মা-ই আছেন যাঁরা বাবার থেকে বেশি আয় করেন, আপিসে তাঁদের খাটুনিও বেশি, তথাপি সন্তানকে দেখাশোনার মূল দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হয়। যে মা সেক্টর ফাইভ থেকে মাঝ রাতে হা-ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁকেও ভোরে উঠে সন্তানকে ইস্কুলের জন্য তৈরি করতে হয়। একটানা অফিসের কম্পিউটারে চোখ রেখে সেই মায়ের যখন চোখ টনটন করে, তিনি একটু চোখ বন্ধ করেন তখনই বাচ্চার আয়ার ফোন আসে, ছেলে (বা মেয়ে) কিছুতেই ভাত খাচ্ছে না, ভীষণ দুষ্টুমি করছে। মা ফোনে বাচ্চাকে ভোলান, আয়া-মাসিকে ঠান্ডা করেন, মেশিনে মনোনিবেশ করেন। আয়ার ফোন সাধারণত বাবাদের কাছে আসে না।

হ্যাঁ, দিন বদলাচ্ছে। এ কালের কিছু বাবা সে আমলের বাবা-কাকাদের থেকে বিস্তর বদলেছেন। বেশ কিছু বাবা আজকাল বাচ্চার দেখাশোনা করেন। কিন্তু সে জন্য তাঁরা বাহবা পান, অথচ মায়েদের ক্ষেত্রে তা কর্তব্যমাত্র। আর এ কালে কিছু বাবা যেমন শিশুর দায়িত্ব সামলান, তেমনই অনেক মা-ও সংসারের ইএমআই-এর বোঝা টানেন। কই সেই মায়েদের জন্য তো কোনও আলাদা করে হাততালির চল দেখি না!

শুধু ঘরেবাইরে গতর খাটিয়েই মায়েদের দায়িত্ব শেষ নয়। নাজমার মতো অনেক মাকেই চার দেওয়ালের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাঁরা বিয়ে ভেঙে বেরোতে পারেন না, কারণ নাজমার মতোই তাঁদেরও প্রশ্ন, বাচ্চাদের স্কুলের ফি ভরবে কে? শুধুমাত্র সন্তানের সফল ভবিষ্যতের আশায় তাঁরা বিয়ের মধ্যে মার খান, কারণ তাঁদের বিশ্বাস করানো হয়, এটাই মায়ের কর্তব্য। মা হওয়ার প্রথম পাঠই হল আত্মত্যাগ। আর এই আত্মত্যাগ সমাজ কেবল মায়েদের কাছেই আশা করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই আত্মত্যাগ মানুষ হিসেবে মেয়েদের ক্ষমতার সোপানে প্রান্তবর্তী করে রাখে না কি? মাকে যদি সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনিতে জীবনপাত করতে না হত, রোজগারের প্রায় পুরোটাই সংসার ও সন্তানের জন্য ব্যয় করতে না হত, নিজের জন্য যদি খানিক সময় এবং অর্থ তিনি ব্যয় করতে পারতেন, তা হলে কি তিনি নিজের উন্নয়নের, আনন্দের আর একটু বেশি অবকাশ পেতেন না? তাঁর চিন্তার জগৎ যদি শুধুমাত্র সন্তানের জন্য কর্তব্যে ঠাসা না থাকত, তা হলে কি সেখান দিয়ে আলোবাতাস চলাচলের অলিন্দ তৈরি হত না? নাজমারা কি নিজের জন্য মুক্তির আস্বাদ পেতেন না? সেই মুক্তি, সেই উত্তরণের গল্প নিয়ে কেন সচরাচর ছবি বানায় না বলিউড? আত্মত্যাগী মায়ের সিনেমা আর কত দিন দেখতে হবে আমাদের? কবে এ দেশের সৃষ্টিশীল মানুষরা বুঝবেন যে, আত্মত্যাগী মা সুপারস্টার নয়, আসলে ভিকটিম? এমন ছবি কবে তৈরি হবে যে ছবিতে নাজমা নিজের জন্য বাঁচবেন? আত্মত্যাগ নয়, আত্মসম্ভ্রমের জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য, মারকুটে স্বামীকে ত্যাগ করবেন মেয়েরা? কবে আমরা বুঝব, মা হওয়াই মেয়েজন্মের একমাত্র সার্থকতা নয়, একটা ‘চয়েস’ মাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Duties Secret superstar sacrifice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE